• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবসের প্রত্যাশা

বর্ণবৈষম্য

প্রতীকী ছবি

ফিচার

বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবসের প্রত্যাশা

  • এটিএম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ
  • প্রকাশিত ২১ মার্চ ২০১৯

বর্ণবাদ হলো বৈষম্যমূলক সামাজিক স্তরবিন্যাস ও আগ্রাসী শক্তির হাতিয়ার। এটি এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি, যা নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য কোন গোষ্ঠী উঁচু বা নিচু, কে বেশি যোগ্য বা অযোগ্য, কে কার ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী। কোনো মানুষের আচরণ যদি কখনো তার জাতি বা বর্ণ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেটি অন্য কারো জন্য ক্ষতিকর না হলেও তাকে বর্ণবাদ বলা যাবে। বর্ণবাদের কথা শুনলেই আমাদের সামনে ফুটে ওঠে আফ্রিকার কথা, সাদা-কালো মানুষের পার্থক্যের কথা, শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা বিশ্বব্যাপী কৃষ্ণাঙ্গদের দাস বানানোর কথা, বর্ণবাদবিরোধী অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার কথা, এই উপমহাদেশে ইংরেজ কর্তৃক ভারতীয়দের খর্ব করে দেখা, দেশভাগের পর পাকিস্তানি কর্তৃক বাঙালিদের দমিয়ে রাখার চেষ্টার কথা ইত্যাদি। তবে পৃথিবীব্যাপী সবচেয়ে বেশি বর্ণবৈষম্য গায়ের রং দিয়ে অর্থাৎ কালো আর সাদা চামড়ার মানুষের মধ্যে। তবে বর্ণবাদ শুধু গায়ের চামড়ার রঙের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, কখনো পেশা দিয়ে হতে পারে, কখনো আঞ্চলিকতা দিয়ে হতে পারে, কখনো গোত্র দিয়ে হতে পারে, কখনো বর্ণ দিয়ে হতে পারে। গায়ের রং দিয়ে বর্ণবাদ সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায়। আর আমাদের উপমহাদেশে পেশার ভিত্তিতে হিন্দুধর্মে বর্ণভেদের সৃষ্টি হয়েছিল।

আজ ২১ মার্চ আন্তর্জাতিক বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস। প্রতি বছরের মতো এই বছরও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হচ্ছে। এই দিনটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৬০ সালের এই দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভ্যালিতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল পার্টির জারি করা বর্ণভিত্তিক আলাদা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। বিনা উসকানিতে সেই মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে ৬৯ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে এবং ১৮০ জনেরও অধিক মানুষকে আহত করে। এই মর্মান্তিক ঘটনাকে উল্লেখ করে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৬৬ সালে পৃথিবীর সব দেশের মানুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য কমানোর জন্য সব দেশের প্রতি জোরালোভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই দিনটি আন্তর্জাতিক বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

বিশ্বের সব দেশের প্রতিটি মানুষের কোনো প্রকার বৈষম্য ছাড়া মৌলিক মানবাধিকার ভোগ করার অধিকার আছে। কিন্তু তারপরও অনেক দেশের সরকার আধিপত্যবাদী চরিত্র ও ব্যক্তিবিশেষের নাকউঁচু স্বভাবের কারণে বর্ণবৈষম্য পুরোপুরিভাবে রোধ করা এখনো সম্ভব হয়ে উঠছে না। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো নিজেদের মানবাধিকারের স্বর্গরাজ্য দাবি করলেও এখনো আমরা সেখানে শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অবজ্ঞার চিত্র প্রতিনিয়ত খবরে দেখতে পাই। আমরা যদি আমাদের আশপাশের দেশগুলোর দিকে তাকালে বর্ণবৈষম্যের ভয়াল চিত্র দেখতে পাই। বছর দু-এক ধরে আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমারের সরকারের ইন্ধনে সেদেশের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন আরাকান প্রদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে শুধু বর্ণগত কারণে, যা আজ আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক ঘৃণিত ও সমালোচিত হয়েছে। অতিসম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের একটি মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজে একজন উগ্রবাদী শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী কর্তৃক বন্দুক হামলায় ৪৯ জন নিহত হওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করে পরদিন ওই সন্ত্রাসীকে আদালতে হাজির করা হলে সে তার হাতের আঙুল দিয়ে বর্ণবাদী চিহ্ন প্রদর্শন করে, যা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে।

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। যেখানে ভিন্ন ভিন্ন জাতি ধর্ম বর্ণ গোত্রের মানুষের বসবাস। দেশের স্বাধীনতার জন্য জাতি ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সবার সক্রিয় অবদান রয়েছে। এদেশের মানুষ জাতি ধর্ম বর্ণ গোত্র পেশা নির্বিশেষে একে অন্যের সঙ্গে নানা সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। আমাদের দেশের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, হরিজন, দলিত, বেদে সমাজের মানুষ, দরিদ্র, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী, ক্ষেত্রবিশেষে নারীরা এখনো বিভিন্নভাবে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এছাড়া জন্মস্থানের কারণেও অনেক সময় কটূক্তিমূলক কথা শুনতে হয়। বাংলাদেশে শ্রম বৈষম্যের অন্যতম একটি জায়গা হলো চা-বাগানগুলো। সেখানে শ্রমিকদের মজুরি অনেক কম। তাদের সন্তানদের শিক্ষার হার খুবই কম। সেখানে শিক্ষার ব্যাপারে তাদের খুব একটা উৎসাহিত করা হয় না। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও প্রায় সব ধরনের ধর্মীয় চর্চা, ব্যক্তিবিশেষের চিন্তায়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বর্ণবাদ প্রথা বিদ্যমান থাকায় এখনো মানুষ বৈষম্য থেকে মুক্তিলাভ করতে পারেনি। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

সাংবিধানিকভাবে আমাদের দেশের অবস্থান বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে। নাগরিকদের প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের জন্য ২০১৪ সালে বৈষম্য বিলোপ আইন ২০১৪ খসড়া তৈরি করা হয়েছিল, যা এখনো চূড়ান্তভাবে আইন আকারে অনুমোদিত হয়নি। এটি কার্যকর হলে বৈষম্যের শিকার ব্যক্তি মামলা করতে পারবেন। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত মানুষগুলো উপকৃত হবে। খসড়া আইনে বলা আছে- ধর্ম বর্ণ ভাষা শারীরিক মানসিক ও লিঙ্গীয় প্রতিবন্ধকতা এবং কথিত অস্পৃশ্যতার অজুহাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বৈষম্যমূলক কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। প্রস্তাবিত খসড়ায় অবহেলিত জনগোষ্ঠীর লোকদের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা লাভের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে প্রথমবার ২ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। শিক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণে বাধা, কর্মলাভে বাধা, জনস্থল, সর্বজনীন উৎসব, নিজ উপাসনালয়ে প্রবেশ ও অংশগ্রহণে বাধা প্রভৃতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। এই আইন যত দ্রুত সম্ভব পাস করার ব্যবস্থা নিতে হবে। গত মাসে ঢাকায় বাংলাদেশ অ্যাজমা অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে আমাদের মাননীয় আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, বৈষম্য বিলোপ আইন তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে এবং অতি শিগগির তা পাস হবে। এটা আমাদের দেশের জনগণের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক।

 

লেখক : চাকরিজীবী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads