• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
নাম তার ‘স্পিরুলিনা’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন স্পিরুলিনাকে খাদ্যের বিকল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে

ছবি : সংগৃহীত

খাদ্য

নাম তার ‘স্পিরুলিনা’

  • ফয়জুন্নেসা মণি
  • প্রকাশিত ২১ জুন ২০১৮

স্পিরুলিনা আবিষ্কারের গল্প : একবার ইউরোপের কিছু গবেষক আফ্রিকার এক এলাকায় গিয়েছিলেন গবেষণার জন্য কিছু ডাটা সংগ্রহ করতে। তারা দেখতে পেলেন ওই এলাকার লোকজন বেশ স্বাস্থ্যবান এবং সুস্থ। আশ্চর্যই হলেন- কীভাবে সম্ভব! কারণ সেখানে এমন কোনো পুষ্টিযুক্ত খাবার ছিল না। গবেষকরা তাদের খাবার তালিকা অনুসন্ধানে খুঁজে পেলেন সবুজ শ্যাওলা বা স্পিরুলিনার তথ্য। এই খাবার মানুষকে সুস্থ ও সবল রাখে। জানা যায়, আফ্রিকার ‘শাদ’ নামক হ্রদ এলাকায় উপজাতীয়দের কাছে এটি অতি পরিচিত। তারা প্রায় ১০০ বছর ধরে স্পিরুলিনা খেয়ে আসছে। তারা এ সবুজ খাদ্যকে ‘দিহে’ বলে থাকে। বিজ্ঞানীরা চার দশকেরও বেশি আগে এই আশ্চর্য পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ও রোগ প্রতিরোধক স্পিরুলিনাকে পরিচিত করেছেন। যার ফলে বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশের মানুষ নিয়মিত এটি খাচ্ছে।

স্পিরুলিনাকে প্রোটিনের অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচনা করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন স্পিরুলিনাকে খাদ্যের বিকল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সাধারণ খাদ্য হিসেবে তো বটেই, নানা রোগ নিরাময়ে মূল্যবান ভেষজ হিসেবে দেশে-বিদেশে স্পিরুলিনার প্রচুর চাহিদা। প্রতি ১০০ গ্রাম স্পিরুলিনায় প্রায় ৩৭৪ কিলোক্যালরি শক্তি রয়েছে। শুষ্ক স্পিরুলিনাতে রয়েছে ৬০%-৭০% অত্যন্ত উচ্চ শ্রেণির কোলেস্টেরলমুক্ত প্রোটিন যা মানবদেহের ভারসাম্যতায় অপরিহার্য পুষ্টির উৎস। এ ছাড়াও এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, লৌহ, প্রয়োজনীয় ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, বিটা ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিংক, ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৬, ভিটামিন কে এবং ভিটামিন ডি।

নাম তার স্পিরুলিনা : স্পিরুলিনা এক প্রকার অতি ক্ষুদ্র নীলাভ সবুজ শৈবাল। এটি সাধারণত পানিতে জন্মে। প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলস সমৃদ্ধ প্রকৃতির আশ্চর্য খাবার স্পিরুলিনা। বর্তমানে কৃত্রিম জলাধারে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন হচ্ছে। অণুবিক্ষণ যন্ত্র ছাড়া এই শৈবালকে খালি চোখে দেখা যায় না। শুধুমাত্র সাধারণ খাদ্য হিসেবে নয়, রোগ নিরাময়ে মূল্যবান ভেষজ হিসেবে দেশে-বিদেশে স্পিরুলিনার প্রচুর চাহিদা।

স্পিরুলিনায় আছে : স্পিরুলিনাতে আছে উচ্চমাত্রার বিটা ক্যারোটিন এবং আরো ১০টি ক্যারোটেনয়েডের বিপুল ভান্ডার যা বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার ও টিউমারের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। স্পিরুলিনা ইনস্যুলিন হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করার কারণে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। স্পিরুলিনা অন্ত্রে হজম শক্তি, রোগ-জীবাণু থেকে রক্ষা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, এইডস প্রতিরোধে সহায়ক। স্পিরুলিনাতে হূদরোগ, ব্রেনস্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস পায় এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনে স্পিরুলিনাকে আগামী দিনের সেরা খাদ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তা ছাড়া জাতিসংঘ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শিশুদের জন্য এটিকে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য বলে সুপারিশ করেছে। জার্মানি ও ভারত থেকে প্রকাশিত জার্নালে দেখানো হয়েছে, সামান্য কয়েক গ্রাম স্পিরুলিনা সেবনে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়, মানুষের হজম শক্তি বাড়ায়- এমনকি চোখের রোগের সংক্রমণ হ্রাস পায়।

স্পিরুলিনা সম্পর্কে অভিমত : ভিটামিন এ, ভিটামিন বি১২ এবং আয়রন এই তিনটি ‘পুষ্টি’ উপাদান রক্ত তৈরির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। এ তিনের সমন্বয় ওয়ান্ডার ফুড ‘স্পিরুলিনা’ ব্যতীত বিশ্বে অপর কোনো খাদ্যে নেই। -প্রফেসর ডা. বি চৌধুরী

আগামী দিনের মানব জাতির রক্ষাকল্পে শ্রেষ্ঠ, সফল খাদ্য হিসেবে ‘ওয়ান্ডার ফুড’ (স্পিরুলিনা) পরিদৃষ্ট হবে। মানবদেহে ঘাটতি পূরণে ‘ওয়ান্ডার ফুড’ (স্পিরুলিনা) ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। -বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

স্পিরুলিনা ট্যাবলেটে রয়েছে উচ্চ মাত্রায় জিএলএ যা মানবদেহের ক্ষতিকারক এলডিএলকে কমিয়ে হূদরোগের ঝুঁকি কমায়। -ডা. শহিদুল ইসলাম, হূদরোগ বিশেষজ্ঞ

বাংলাদেশে স্পিরুলিনা : আমাদের জন্য আশার কথা হলো, এই স্পিরুলিনা দিন দিন বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হচ্ছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (BCSIR) থেকে প্রকাশিত জার্নালে দেখা যায়, বাংলাদেশের জলবায়ু স্পিরুলিনা উৎপাদনে জন্য বেশ সহায়ক এবং এ দেশের আবহাওয়ায় সারা বছর বিপুল পরিমাণ স্পিরুলিনা চাষ করা সম্ভব। বাংলাদেশে BCSIR-এর ফর্মুলা ও তত্ত্বাবধানে শৈবাল স্পিরুলিনা থেকে বিশেষ উপায়ে ট্যাবলেট তৈরি করা হচ্ছে।

স্পিরুলিনার গুণ ও ব্যবহার : বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের বিশেষজ্ঞদের মতে, স্পিরুলিনার গুণাগুণ অনেক। নিয়মিত সেবনে দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে পুষ্টিহীনতা, রক্তশূন্যতা, রাতকানা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আলসার, বাত, হেপাটাইটিস ও ক্লান্তি দূর করে। স্পিরুলিনায় আছে প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিজ্জ আমিষ, ৬০-৬৩% যা কি না মাছ বা মাংসের চাইতে ৩-৪ গুণ বেশি। স্পিরুলিনা শরীর থেকে বের করে দেয় দিনের পর দিন জমে ওঠা ক্ষতিকর সব টক্সিন। এটি পরিশ্রম করার ক্ষমতা বাড়ায় এবং নিয়ন্ত্রণে রাখে শরীরের ওজন। বর্তমানে ট্যাবলেট বা রুটি, আলু ভর্তা, নুডলস, শরবত, হালুয়া ইত্যাদিতে স্পিরুলিনা মিশিয়ে নানা জাতীয় স্পিরুলিনা সমৃদ্ধ খাবার তৈরি করে বাজারজাত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে খাবার তৈরি করার সময় অবশ্যই পরিমাণ অনুযায়ী স্পিরুলিনা মেশাতে হবে। বর্তমানে স্পিরুলিনাযুক্ত পাউরুটি ও স্পিরুলিনা পানীয় বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।

কীভাবে খাবেন : স্পিরুলিনা পাওয়া যায় ট্যাবলেট এবং গুঁড়ো হিসেবে। স্পিরুলিনার গুঁড়ো পানিতে অথবা জুসের সঙ্গে গুলিয়ে খেতে পারেন। ট্যাবলেট খেতে পারেন দিনে ৪-৬টা। তবে আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।

আর্সেনিক মুক্তিতে স্পিরুলিনা : জরিপ তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৪টি জেলার টিউবওয়েলের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্ব ব্যাংকের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এ সমস্যার ভয়াবহতায় পাঁচ কোটি লোক আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করায় তাদের স্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখিন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ডাক্তার এবং BCSIR-এর বিজ্ঞানীরা ৬০ জন রোগীর ওপর স্পিরুলিনা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে দেখেন, প্রতিদিন ৯-১০ গ্রাম করে স্পিরুলিনা খাওয়ালে ৪-৬ মাস পর রোগীর আর্সেনিকজনিত চর্মরোগ (আর্সেনিকোসিস) সম্পূর্ণরূপে উপশম হয়। যেহেতু এখন পর্যন্ত আর্সেনিকের কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি, সে ক্ষেত্রে স্পিরুলিনা সেবন করে আর্সেনিকমুক্ত থাকাটা সত্যিই আমাদের জন্য বিরল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads