• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র

দ্বৈতনীতির সুযোগে স্বেচ্ছাচারিতা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৪ নভেম্বর ২০২০

রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড ও মাইন্ড কেয়ার ইনস্টিটিউটের কর্মচারীদের নির্যাতনে মারা যান পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুল করিম শিপন। এরপরই কথা আসে মাদক নিয়াময়কেন্দ্রের নামে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কী হয়? তাদের নিয়ন্ত্রণই বা করে কারা? এসব প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্চাচারিতার কোনো বিচার হয় কি? লাইসেন্স পেতে তাদের কী কী করণীয় আছে? তার কতটুকু পালন করে তারা? আর অনিয়ম হলে কখনো কি তাদের লাইসেন্স বাতিল হয়?

যদিও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়েই আদাবরের বায়তুল আমান হাউজিংয়ের ২ নম্বর সড়কের ২৮১ নম্বর বাড়িটিতে চলছিল মাইন্ড এইড মানসিক ও মাদকাসক্তি নিরাময় হাসপাতালটির কার্যক্রম। পরে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো নাম রাখে মাইন্ড এইড ও মাইন্ড কেয়ার ইনস্টিটিউট। একটি লাইসেন্স ও বিশেষ কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহিতা না থাকার সুবাদেই স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন মাইন্ড এইড ও মাইন্ড কেয়ার সংশ্লিষ্টরা। ভুক্তভোগী একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র এমনটি জানায়। পুলিশ কর্মকর্তা শিপনের মৃত্যুর পর মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের একাধিক সূত্রও এমনটি জানায়। 

জানা যায়, দেশের সব হাসপাতালই চলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নীতিমালা অনুযায়ী। কিন্তু সেখানে যদি মাদকাসক্ত থাকে তবে সেটা চালাতে হয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নীতিমালা অনুযায়ী। অর্থাৎ সারা দেশে যেসব বেসরকারি মানসিক রোগের হাসপাতাল রয়েছে, তাদের জন্য দুই অধিদপ্তরের দুই নীতি। ফলে একক নজরদারি থাকে না। এমন দ্বৈতনীতির সুযোগেই মাইন্ড এইডের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো স্বেচ্ছাচারিতা করে।

পুলিশ কর্মকর্তা শিপনের মৃত্যুর পরই আলোচনায় আসে মাইন্ড এইড ও মাইন্ড কেয়ার প্রতিষ্ঠানটি। প্রশ্ন ওঠে, কী করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান মাদক নিরাময় হাসপাতাল হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল?

গত বৃহস্পতিবার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ‘মাইন্ড এইড মানসিক ও মাদকাসক্তি নিরাময় হাসপাতাল’-এর লাইসেন্স বাতিল করেছে। এ ঘটনায় আদাবর থানায় মামলাও হয়েছে। হাসপাতালের মালিকসহ ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ১১ জন।

জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রের নামে গড়ে উঠেছে নির্যাতন সেল। এসব কেন্দ্রে থাকে না প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী। নেই কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞও। মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে অভিযান হয় এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। কিন্তু ঢালাওভাবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। লাইসেন্স প্রদান ও নজরদারির ক্ষেত্রে কড়া কোনো কর্তৃপক্ষ নেই বলেই চিকিৎসার নামে নির্যাতন আর বাণিজ্য চালানোর সুযোগ পায় এরা।

এরই মধ্যে দেশের অবৈধ মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর তালিকা চেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আগামীকাল রোববারের মধ্যে তালিকা জমা দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। তারপর সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

মাদকসক্তিকে মানসিক রোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ফলে মানসিক স্বাস্থ্য এবং মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রগুলোকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের লাইসেন্স দেবে, তারাই মনিটরিং এবং সুপারভিশন করবে, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতীয় মানসিক হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘হাসপাতালের কার্যক্রম তদারকির মতো বিশেষজ্ঞ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নেই। যে কারণে এ ধরনের কেন্দ্রগুলো স্বেচ্ছাচারী হয়। এদের বেশিরভাগেরই কেবল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লাইসেন্স আছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া লাইসেন্স নেই।’ ‘এ ধরনের নিরাময়কেন্দ্রগুলোকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল সংক্রান্ত নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। আর এদের লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাহলেই কেবল এগুলোর মানোন্নয়ন সম্ভব,’ বলেন ডা. হেলাল আহমেদ। তিনি আরো বলেন, ‘ব্যাঙের ছাতার মতো অবসরপ্রাপ্ত মাদকাসক্তদের (রিকভারি অ্যাডিক্ট) দিয়ে নিরাময় কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। এ চর্চাও বন্ধ করতে হবে। রিকভারি অ্যাডিক্টরা বলে থাকে, তারা চিকিৎসকদের চেয়েও নাকি ভালো কাজ করে। তারা বলে বেড়ায়, তারা জানে কীভাবে মাদক ছাড়াতে হয়। ওই রিকভারি অ্যাডিক্টরাই এ ধরনের সেবাকেন্দ্র খুলে বসছে, আর যা-তা কাজ করছে।’

এসব কেন্দ্র বন্ধ করতে সরকারি মানসিক হাসপাতাল এবং সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর মানসিক রোগ বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়াতে হবে মন্তব্য করে ডা. হেলাল আহমেদ আরো বলেন, ‘হয়তো নোংরা পরিবেশে আমরা চিকিৎসা দেই, হয়তো বাথরুমটা পরিষ্কার নয়। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নেই যে রোগীকে নির্যাতন করা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোকে ক্ষমতায়িত করতে হবে। সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।’

ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন ডা. আবু হোসেইন মোহাম্মদ মইনুল আহসান বলেন, ‘মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কিন্তু অন্য চিকিৎসাও দিতে হয় রোগীকে। আর তার জন্য অনেকগুলো শর্ত পূরণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স পেতে হয়। কিন্তু এসব বেসরকারি নিরাময়কেন্দ্রগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স না নিয়ে কেবল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স দিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বলেন, ‘মাইন্ড এইড নামের প্রতিষ্ঠানটি আমাদের কাছে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু অনেকগুলো শর্ত পূরণ না করায় ওদের আমরা লাইসেন্স দেইনি।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, লোকবলের সীমাবদ্ধতার কারণে নিরাময়কেন্দ্রগুলো যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। এ সুযোগে অনেক প্রতিষ্ঠান নানা ধরনের অনিয়ম করে যাচ্ছে। সরেজমিন পরিদর্শন করে যেসব প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম পাওয়া যাবে সেগুলো বন্ধ করে দেব।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকেন্দ্র থেকে মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসনের লাইসেন্স দেওয়া হয়। এই বিভাগের পরিচালক মু. নুরুজ্জামান শরীফ বলেন, ‘একটি নিরাময়কেন্দ্র যে নামে লাইসেন্স নেবে, সেই নামেই তার সাইনবোর্ডসহ সব কার্যক্রম চালাবে। নাম পরিবর্তন করতে পারবে না। নাম পরিবর্তন করা বেআইনি।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads