• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

‘আমাদের দেখার কেউ নেই’

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ০৬ জুলাই ২০২১

দফায় দফায় লকডাউনে যেসব খাত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম যাত্রীবাহী লঞ্চ খাত। প্রথম দফা লকডাউনে কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর গত ৫ এপ্রিল দ্বিতীয় দফার লকডাউনে এক মাস ১৯ দিন বন্ধ ছিল লঞ্চ চলাচল। এরপর মাত্র ২৩ দিনের ব্যবধানে তৃতীয় দফার কঠোর লকডাউনের ফাঁদে পড়ে আবারো বন্ধ হয়ে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের এই সেক্টরটি। যদিও এই সময়ে দেশের তৈরি পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কলকারখানার পাশাপাশি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে খুলে দেওয়া হয়েছিল দোকানপাট, শপিংমল, গণপরিবহনসহ প্রায় সব ধরনের অফিস-আদালত। কিন্তু সংক্রমণ এড়াতে সরকার বাধ্য হয় লঞ্চ বন্ধ রাখতে। এতে চরম হুমকির মুখে পড়েছেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৫ লাখ কর্মজীবী মানুষ ও লঞ্চ মালিকরা।

কোটি কোটি বিনিয়োগে নির্মিত লঞ্চগুলো লকডাউনে চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেও প্রতিটি লঞ্চের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এবং শ্রমিকদের বেতনভাতা দিতে হচ্ছে মালিকদের। অন্যদিকে দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকলে নানা যান্ত্রিক ত্রুটির শঙ্কাও রয়েছে। আর এসবের পেছনের প্রতি মাসে বিপুল অঙ্কের অর্থ গুনতে হচ্ছে মালিকদের।

এ নিয়ে নিজেদের অবস্থার কথা বলতে গিয়ে হতাশাজনিত কণ্ঠে নিজাম শিপিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অ্যাডভেঞ্চার লঞ্চের মালিক নিজাম উদ্দিন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আমাদের সব শেষ! লঞ্চ তো শেষই, এখন আমাদের চলার মতো সঙ্গতি নেই। স্টাফদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হয়। এগুলো কোত্থেকে দেব? এই সেক্টরে সরকারের কোনো সহায়তা নেই। পারলে আমাদের নিয়ে একটু লিখবেন। এত বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও এই সেক্টরের দিকে সরকারের দৃষ্টি নেই।’

তিনি বলেন, ‘কেবল লাখ লাখ যাত্রী পরিবহনই না, লঞ্চের মাধ্যমে অল্প খরচে পণ্য পরিবহন হয়ে থাকে। সুতরাং প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে আমরা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমাদের কোনো সহায়তা কিংবা তেমন কোনো স্বীকৃতি নেই। ব্যাংকগুলো আমাদের ঋণ দিতে চায় না। অথচ সরকার বিভিন্ন সেক্টরের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা সহায়তা দিয়েছে।’

তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রণোদনা নয়, সরকারের কাছে শ্রমিকদের বেতনভাতা দেওয়ার জন্য নগদ আর্থিক সহায়তার দাবি করে নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘ঈদের সিজনে আমাদের আয় একটু বেশি হয়। কিন্তু আগামী কোরবানির ঈদসহ এ পর্যন্ত চারটি ঈদেই আমাদের লঞ্চ বন্ধ রাখতে হয়েছে। অথচ গত ১৬ মাস ধরে ঠিকই শ্রমিকদের বেতন ভাতা দিতে হয়েছে। এখন আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি।’

অন্যদিকে লঞ্চ বন্ধ থাকায় বিপাকে আছেন যথারীতি শ্রমিকরাও। তারা বলছেন, লঞ্চ বন্ধ থাকলে অর্ধেক বেতন দেওয়া হয় তাদের। তাদের দাবি, এমনিতেই লঞ্চশ্রমিকদের বেতন তেমন বেশি না। তাদেরকে উপড়ি ইনকামের ওপরই নির্ভর করতে হয়। এছাড়া গত ঈদগুলোতে তারা কোনো বোনাস পাননি। আর দীর্ঘদিন লঞ্চ বন্ধ থাকায় মালিকদেরও তারা চাপ দিতে পারছেন না। সুন্দরবন-১৪ লঞ্চের সুপারভাইজার মোহাম্মদ ইউনুস হোসাইন বলেন, ‘আমরা এমন একটা পরিস্থিতিতে আছি যে, অন্য কোনো কর্ম করে খাব সেই সুযোগও নেই। লঞ্চ বন্ধ থাকলেও লঞ্চেই থাকতে হয় আমাদের। সরকারও আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না। এভাবে আর কিছুদিন চললে না খেয়ে মরতে হবে। ’

এদিকে গত রোযার ঈদের আগে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কর্মহীন মানুষদের নগদ আড়াই হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হলেও লঞ্চ শ্রমিকদের অধিকাংশই তা পাননি বলে জানান ইউনুস হোসাইন। তিনি বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষ থেকে আমাদের লঞ্চের ৪০ জনের মধ্যে সবারই মোবাইল নম্বর নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সহায়তা পেয়েছে মাত্র ৩ জন।’

তবে প্রধানমন্ত্রী ঈদ উপহার না পাওয়ার প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক (নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ) মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার মূলত অনলাইনভিত্তিক। তাই এটি যদিও কেউ পেয়ে না থাকেন, সেটির জন্য আমরা দায়ি না। কারণ, এটি একটি প্রক্রিয়াগত ব্যাপার। সেই প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণেই হয়তো তারা উপহার পাননি।’

বাংলাদেশ নৌ-যান শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘নৌ-শ্রমিকদের দেখার কেউ নেই। তাদের এখন অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে।’

তিনি জানান, বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় পাঁচ লাখ নৌ-যান শ্রমিক রয়েছেন। ঈদকে সামনে রেখে প্রতি বছর এই সময়টাতে শ্রমিকরা কর্মমুখর থাকেন। কিন্তু লকডাউনের কারণে আমাদের শ্রমিকরা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। এমনকি শ্রমিকদের সামান্য কিছু সহায়তা দেওয়ারও কেউ নেই। তিনি বলেন, ‘মালিকদেরও আমরা চাপ দিতে পারছি না। লঞ্চ বন্ধ থাকায় তারাও আছেন বিপাকে।’

এদিকে সদরঘাটে লঞ্চের চলাচলের সঙ্গে যুক্ত কয়েকশ ঘাট শ্রমিকের (কুলি) জীবন-জীবিকাও। লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন এসব শ্রমিক। লঞ্চ শ্রমিকদের অনেকেই বেতন-ভাতা পেলেও এসব শ্রমিক কাজ করেন দিনমজুর হিসেবে। অর্থাৎ কাজ না থাকলে উপার্জনও বন্ধ হয়ে যায় তাদের। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ঘাট শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘লঞ্চ চালু থাকলে আমাদের উপার্জন থাকে। আর লঞ্চ বন্ধ থাকলে উপার্জনও বন্ধ। এ পর্যন্ত কারো কাছ থেকে আমাদের শ্রমিকরা কোনো সাহায্য-সহযোগিতাও পায়নি। এ কারণে তারা অনেক কষ্টে আছে।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads