• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

বন্ধ হয়নি সিটিং সার্ভিস

বাসে নেই ভাড়ার তালিকা

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ১৫ নভেম্বর ২০২১

রাজধানীর গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য যেন কমছেই না। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বাসভাড়া বাড়ানোর সপ্তাহখানেক পর গতকাল রোববারও নেওয়া হয়েছে ওয়েবিলের নামে বাড়তি ভাড়া। এদিকে যাত্রী হয়রানি বন্ধে গণপরিবহনে সিটিং সার্ভিস, গেইটলক সার্ভিস বা ওয়েবিল পদ্ধতি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিল মালিক সমিতি। গতকাল ছিল সেই নির্দেশ বাস্তবায়নের প্রথম দিন। কিন্তু গতকাল প্রায় সব পরিবহনই চলেছে আগের নিয়মেই। কিছু বাসে জ্বালানি ব্যবহার সংক্রান্ত স্টিকার লাগানো থাকলেও ভাড়ার তালিকা নেই বেশিরভাগ বাসে। ভাড়া তদারকিতে নামমাত্র বিআরটিএর কিছু ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হলেও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের তৎপরতা ছিল আগের মতোই। ফলে এ সুযোগে যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে বাড়তি ভাড়া। আর চালক হেলপারের সাথে ভাড়া নিয়ে প্রায় বাসের যাত্রীদের সঙ্গেই হয়েছে বািবতণ্ডা। 

অন্যদিকে আগের মতোই গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ওয়েবিলের নামে গাড়ির যাত্রী গুণে লিখে দিতে দেখা গেছে বাস কোম্পানির চেকারদের। যদিও চেকারদের দাবি, ওয়েবিল বন্ধই আছে। কিন্তু যাত্রীদের হিসাব রাখার জন্য তারা নির্ধারিত সিটে যাত্রী সংখ্যা লিখে রাখছেন। অন্যদিকে ঘোষণা দিয়েও ওয়েবিল বন্ধ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন যাত্রীরা।

ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণে গত ৭ নভেম্বর ঢাকায় ডিজেলচালিত বড় বাসে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ২ টাকা ১৫ পয়সা ও মিনিবাসে ২ টাকা ৫ পয়সা নির্ধারণ করে দেয় বিআরটিএ। বড় বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ঠিক করা হয় ১০ টাকা, মিনিবাসে ৮ টাকা। যেসব বাস সিএনজিতে চলে, সেগুলোর ভাড়া বাড়বে না।

এরপর গত বুধবার ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির কার্যালয়ে বাস ভাড়া বাড়ানোর পরবর্তী অবস্থা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্যাহ জানিয়েছেন, রোববার থেকে রাজধানীতে ওয়েবিল সিস্টেমেও আর বাস চলবে না। গাড়িতে ভাড়ার চার্ট ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।

গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অন্যদিনের মতোই রজনীগন্ধা, ট্রন্সসিলভা, হিমাচল, শিকড় পরিবহন, ওয়েলকামসহ আরো বেশ কয়েকটি বাস কোম্পানির নিজস্ব চেকাররা ছাউনিতে বসে আছেন। মাথার ওপর ঝুলিয়ে রেখেছেন ওয়েবিলের কাগজ। কিছুক্ষণ পর পর বাস আসতেই তারা ছুটে যাচ্ছেন বাসে। অন্যসময়ের মতো বাসে কতজন যাত্রী উঠছে তা সিটে লিখে রাখছেন। পাশাপাশি কন্ডাক্টরের কাছ থেকে ১০টাকা করে রেখে দিচ্ছেন। আগেও এসব চেকাররা প্রতিবার স্বাক্ষরের জন্য ১০টাকা করে বাস থেকে নিতেন।

যাত্রীরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত ভাড়া দিতে না চাইলে পথে নামিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে চালকেরা। তারা আমাদের কাছ থেকে ভাড়া বেশি নিচ্ছে। ভাড়া নিয়ে কিছু বললেই গাড়ি বন্ধ করে আমাদের হুমকি দিচ্ছে গাড়ি চালাবে না। আবার অনেক বাসের চালক যাত্রীদের বলছেন মালিককে ফোন দিতে। অন্যদিকে বাসের কন্ডাক্টর ও চালকেরা বলছেন, কোম্পানি থেকে তাদের কোনো নির্দেশনা দেয়নি। তাদের কাছ থেকে বাস মালিক ওয়েবিল হিসাবে পূর্বের টাকাই নিচ্ছে। বাস কোম্পানি থেকে চালকদের বলেছে ওয়েবিলের হিসাবে ভাড়াই নেওয়ার জন্য। আর সরেজমিনে বেশিরভাগ স্থানে যাত্রীগুনে ওয়েবিলের টাকা নিতেও দেখা গেছে।

এদিকে রাজধানীতে খুব একটা দেখা যায়নি ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ বা বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত ও পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সমিতির তদারকি। এ অবস্থায় সার্ভিস ও ওয়েবিলের সিস্টেমের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের।

কামাল হোসেন নামে এক যাত্রীর বলেন, সিটিং-গেটলক সার্ভিস থাকবে না বলে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্লাহর ঘোষণার পর গাড়ি থেকে ভাড়ার চার্ট নাই হয়ে গেছে। কিন্তু ওয়েবিলের নামে বাড়তি ভাড়া ঠিকই আদায় করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি গত বৃহস্পতিবার চার্টের একটা ছবি তুলে মোবাইলে রেখে দিয়েছিলাম। আজ (রোববার) বাসে উঠে দেখি-ঠিকই গাড়িতে ভাড়ার চার্ট নেই। হেলপার শ্যাওড়াপাড়া থেকে সুপ্রিম কোর্ট ভাড়া চাইলো ৩৫ টাকা। অথচ চার্ট অনুযায়ী ভাড়া ২৪ টাকা। অতিরিক্ত ভাড়া চাওয়ায় ভাড়া দিতে চাননি এই যাত্রী। তিনি হেলপারকে পাল্টা বলেন, শাহবাগে পৌঁছে পুলিশ সার্জেন্টকে ডেকে ভাড়া দিবো। পরে তাদের ওয়েবিলের কাগজের পেছনে ‘লুকিয়ে রাখা’ একটা ভাড়ার চার্ট এনে দেন হেলপার।

এ যাত্রী আরো বলেন, আমি তাকে দেখালাম যে কাজীপাড়ার পর থেকে প্রেস ক্লাব পর্যন্ত ভাড়া ২৪ টাকা। এরপর হেলপার বললো, আচ্ছা দেন। আমি তাকে ২৫ টাকা দিলাম। এবার বাসের অন্য যাত্রী যারা এতক্ষণ না বুঝতে পেরে ৫-৯ টাকা বেশি দিয়েছেন তারা তর্ক করে বাড়তি টাকা ফেরত নিলেন।

এ বিষয়ে কয়েকজন চেকার জানান, ঘোষণা দিলেও মালিকরাই আমাদের মাঠে রেখেছেন। আমরা যাত্রী কতজন হচ্ছে লিখে রাখছি। নইলে সারাদিন কত যাত্রী চললো তার হিসাব তো পাওয়া যাবে না। আগের ওয়েবিল আর এখনকার সময়ের মধ্যে পার্থক্য কি? এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে কিছুটা বিব্রতবোধ করেন চেকাররা। তবে একজন চেকার বলেন, ঘোষণা দিছে ওই জায়গাই শেষ। দুদিন পর আর কেউ এসব নিয়ে কথাও বলবে না।

এদিকে নির্দেশ না মানলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি মালিক সমিতির। আর বিআরটিএ বলছে, নিয়ম না মানলে করা হবে মামলা, বাতিল হবে রুট পারমিট।

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্লাহ বলেন, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী  রোববার থেকে সিটিং-গেটলক সার্ভিস বন্ধ থাকবে। এ নির্দেশনা না মানলে বিআরটিএর মাধ্যমে বাসের লাইসেন্স ও রুট পারমিট বাতিল করা হবে। এছাড়া বাস মালিকের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে রাজধানীতে ‘সিটিং সার্ভিস’ বন্ধে গতকাল ভ্রাম্যমাণ আদালত মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিববহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গতকাল সকাল থেকে ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করেছে।

বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. সরওয়ার আলম বলেন, সিটিং সার্ভিস, গেটলকের নামে কেউ যেন অতিরিক্ত ভাড়া না নেয়, তা নিশ্চিত করা হবে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আটটি এবং জেলা প্রশাসনের দুটি ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে। এক টাকা বেশি ভাড়া নিলেও আমরা ধরছি। এছাড়া অন্য কোনো সমস্যা থাকলেও সেটাও দেখছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।

প্রসঙ্গত ২০১৭ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অভিযানও চালিয়েছিল। ওই অভিযানের পর কার্যত ধর্মঘটের পরিস্থিতি তৈরি হলে আবার চলতে শুরু করে সিটিং সার্ভিস বা ওয়েবিল পদ্ধতিতে।

বিআরটিএ ওইসময় সিটিং সার্ভিস বিষয়ক একটি কমিটি করেছিল। কমিটি ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেছিল। তাতে ২৬টি সুপারিশ ছিল। এসব সুপারিশের মধ্যে ছিল- রাজধানীর বিভিন্ন রুটে সীমিত আকারে সিটিং সার্ভিস বাস রাখতে হবে, প্রারম্ভিক ও শেষ স্টপেজের মধ্যে পুরো দূরত্বের ভাড়া আদায় করা যাবে না, এজন্য আলাদা ভাড়া নির্ধারণ করা হবে। গত চার বছরে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি। এরই মধ্যে গতকাল থেকে সিটিং সার্ভিস বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দেয় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।

সিটিং সার্ভিসের বিষয়ে সুরাহার জন্য ২০১৭ সালের এপ্রিলে গঠিত কমিটির প্রধান ছিলেন বিআরটিএ-এর পরিচালক (সড়ক নিরাপত্তা) মাহবুবে রব্বানী। কমিটির সদস্য হিসেবে ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ট্রাফিক, উত্তর), একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক পরিচালক (সংবাদ) ইশতিয়াক রেজা, দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি শ্যামল সরকার, বিআরটিএ-এর তৎকালীন ঢাকা বিভাগীয় উপ-পরিচালক মো. মাসুদ আলম, বাস মালিক প্রতিনিধি মাহবুবুর রহমান ও শ্রমিক প্রতিনিধি শাহজাহান বাবুল।

ওই কমিটির সদস্য বিশিষ্ট সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত বলেন, আমরা যে সুপারিশগুলো তৈরি করেছিলাম তা সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং বিআরটিএ-এর কাছে দিয়েছি। কোনো সুপরিশ বাস্তবায়ন হয়নি। এ অবস্থায় আবার সিটিং সার্ভিস বন্ধ করার জন্য ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তাতে কোনো কার্যকর ফল হবে কি না সন্দেহ আছে। কারণ পুরো ব্যবস্থাকেই নতুন করে সাজাতে হবে, সংস্কার করতে হবে। 

ওই কমিটি তখন সুপারিশ করেছিল-একটি কোম্পানির সব বাস সিটিং সার্ভিসের আওতায় পরিচালনা না করে কিছু বাস সিটিংয়ের আওতায় পরিচালনা করা যায়। এছাড়া কোনো বাস কোম্পানির বাকি বাসগুলো নন-সিটিং হিসেবে পরিচালনা করতে হবে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে কমিটি পর্যবেক্ষণে বলেছিল- সিটিং সার্ভিসের মাধ্যমে দীর্ঘদিন চলাচল করে যাত্রীরা অভ্যস্ত। মালিকরা সিটিং সার্ভিস পরিচালনায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করায় সিটিং সার্ভিস এখন সময়ের চাহিদা। কিন্তু কোনো কোম্পানির কতগুলো গাড়ি সিটিং, কতগুলো নন-সিটিং হিসেবে চলাচল করবে তা ঠিক করতে পারে আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি।

সরকার সিটিং সার্ভিসের ভাড়া নির্ধারণ করবে। একটা রুটকে কয়েকটা স্ল্যাবে ভাগ করে স্ল্যাবভিত্তিক ভাড়া নির্ধারণ করার সুপারিশ করেছিল কমিটি। এছাড়া কমিটি সিটিং সার্ভিসের বাসগুলোয় আলাদা রঙ দিয়ে চিহ্নিত করার সুপারিশ করেছিল। সিটিং সার্ভিস বাসের সীমিত স্টপেজ রাখার সুপারিশও করা হয়েছিল। তবে এই সিটিং সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৭ সালেও এই অবস্থা ছিল। ওই বছরের ১৬ এপ্রিল থেকে সিটিং সার্ভিস বাস চালানো বন্ধের ঘোষণা দেয় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। পরে বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। তাতে পরিবহন সংকট ও এক পর্যায়ে ধর্মঘট পরিস্থিতি হলে ওই বছরের ১৯ এপ্রিল  অংশীজনদের সঙ্গে সভার পর সিটিং সার্ভিসের বিরুদ্ধে অভিযান স্থগিত করে বিআরটিএ।

২০১৭ সালে গঠিত কমিটি রুট পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে ঢাকায় বাসগুলোকে নির্দিষ্ট কয়েকটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলাচলের ব্যবস্থা, রুট ফ্র্যাঞ্চাইজিং পদ্ধতিতে গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার সুপারিশ করেছিল। এছাড়া বিআরটিসির নতুন দ্বিতল বাস চালুর সুপারিশ করেছিল। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads