জবি শিক্ষার্থী অবন্তিকার আত্মহত্যা : ১ বছরেও প্রকাশ হয়নি তদন্ত রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৫, ০০:৫২
-67d5cc6a5d233.jpg)
গেলো বছর ১৫ মার্চ রাতে নিজের ফেসবুক আইডিতে সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা। তার মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হয়েছে। মৃত্যুর আগে তিনি ফেসবুক পোস্টে তার মৃত্যুর জন্য একজন সহপাঠী ও একজন সহকারী প্রক্টরকে দায়ী করেন।
কুমিল্লায় নিজ বাড়িতে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সেই সময়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ মার্চ তদন্ত কমিটি গঠন করে সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট প্রদানের নির্দেশ দেয় প্রশাসন। তবে এই তদন্ত রিপোর্ট এক বছরেও প্রকাশ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্ত শিক্ষক দ্বীন ইসলাম ও ছাত্র আম্মানকে বহিষ্কার করা হলে সেই সিদ্ধান্ত বহাল রয়েছে। এতদিনেও প্রকাশ হয়নি পুলিশি রিপোর্টও। এই ঘটনায় অবন্তিকার মা মামলা করলেও হয়নি চার্জশিট।
জানা যায়, গত বছর ১৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি জাকির হোসেনকে আহ্বায়ক করে গঠিত তদন্ত কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন আবুল হোসেন, আইন অনুষদের ডিন মাসুম বিল্লাহ, সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান ঝুমুর আহমেদ এবং আইনকর্তা রঞ্জন কুমার। এই কমিটি ১৩ জুন তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে। তদন্ত রিপোর্ট সর্বশেষ সিন্ডিকেটে উঠলেও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। এমনকি প্রকাশও করা হয়নি এই রিপোর্ট।
১ বছরেও মেলেনি পুলিশি প্রতিবেদন, হয়নি চার্জশিট
অবন্তিকা হত্যা প্ররোচনা মামলায় তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্ত শিক্ষক ও ছাত্র গ্রেফতার হলেও গত ১ বছরে এখনো চার্জশিট গঠন হয়নি। পাওয়া যায়নি পুলিশ প্রতিবেদন। পাওয়া যায়নি ময়নাতদন্ত ও ফরেনসিক রিপোর্ট।
সূত্র জানায়, হত্যা চেষ্টার এই মামলায় অভিযুক্ত আসামিদের বিরুদ্ধে বিশেষ কোনো প্রমাণ এখনও মেলেনি। ফলে এই মামলায় চার্জশিট গঠন হয়নি। এদিকে মামলার তদন্ত কার্যক্রম না এগোলেও একের পর এক বদলি হচ্ছে তদন্ত কর্মকর্তা।
মামলাটির বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, তদন্ত রিপোর্ট কবে নাগাদ প্রকাশ করা হবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। সিনিয়র অফিসারদের জানিয়ে তারপরে এই তদন্তের রিপোর্ট কোর্টে জমা দিতে হবে।
রিপোর্ট কবে নাগাদ কোর্টে উঠতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটাও বলা যাচ্ছে না, তবে শীঘ্রই জমা দেওয়া হবে। জমা দিলে জানানো হবে।
অনিশ্চয়তায় ছাত্রের শিক্ষাজীবন, শিক্ষকের চাকরি
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আলটিমেটামের ৬ ঘণ্টার মধ্যেই ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মানকে পুলিশ আটক করে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে আম্মান ও শিক্ষক দ্বীন ইসলামকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। গ্রেপ্তার হয়ে দ্বীন ইসলাম প্রায় ৪ মাস ও আম্মান প্রায় ৮ মাস জেল খাটেন। এখন তারা দুজনেই জামিনে আছেন, তবে ক্লাসে ফিরতে পারেননি কেউ।
আম্মানের বন্ধুদের মাস্টার্স শেষ হতে চললেও তার বাকি শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত। একই অবস্থা শিক্ষক দ্বীন ইসলামেরও। তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ না হওয়াতে ও পুলিশি রিপোর্ট না আসায় চাকরিতে যোগদানের অনুমতি পাচ্ছেন না তিনি। বন্ধ হয়ে আছে বেতন-ভাতাও।
অভিযুক্ত শিক্ষার্থী আম্মান বলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকার কারণে সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে গেলে অনেক ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বহিষ্কার করার ফলে আমি মাস্টার্সও শেষ করতে পারছি না। এতে আমার ক্যারিয়ারের ওপর অনেক বড় প্রভাব পড়ছে। আমি চাই, জবি প্রশাসন দ্রুত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করুক। যদি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আমার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায় তবে আমার বিরুদ্ধে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক, আর যদি আমি নির্দোষ প্রমাণিত হই তাহলে আমার ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক।
অভিযুক্ত শিক্ষক দ্বীন ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আচরণ করছে। আমার প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। এই রিপোর্ট ২ জানুয়ারি ৯৯তম সিন্ডিকেট সভায় উঠেছে। এই আত্মহত্যায় আমি জড়িত কিনা বা এই রিপোর্টে আমার সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা, সে বিষয়ে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের চিঠিতে কিছু লেখা হয়নি। সেখানে শুধু লেখা হয়েছে, আদালতের মামলা শেষ হলে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করানো হবে। আমার প্রশ্ন, যদি আদালতের মামলার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটি কেন গঠন করা হয়েছিল? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে হয়রানি করছে। তৎকালীন প্রক্টর মোস্তফা কামাল সেই সময়ে অবন্তিকার অভিযোগ আমলে নেননি। এই আত্মহত্যার দায় তারও।
দ্রুত তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে ন্যায় বিচারের দাবি অবন্তিকার মায়ের
অবন্তিকার মা তাহমিনা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই তদন্ত রিপোর্ট কিভাবে প্রকাশ করবে! প্রকাশ করলে তো কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হয়ে আসবে। তারপরও আমি হাল ছাড়বো না। এই রিপোর্টের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার গিয়াস উদ্দিন আমার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেন। প্রশাসন শুধু বলে আমরা শাস্তির ব্যবস্থা নিচ্ছি, কিন্তু তারা কী ব্যবস্থা নিচ্ছে সেটা নিজেরাই জানে না। এক বছর হয়ে গেল, কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অবন্তিকার আত্মহত্যায় যারা দায়ী তারা মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তাহলে প্রশাসন তাদের কী শাস্তি দেবে? আমি জানতে চাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রেজাউল করিম বলেন, এ আত্মহত্যার সঙ্গে আমাদের যেসব শিক্ষক এবং যেসব ছাত্র-ছাত্রীরা জড়িত আছে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় সে বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে এবং আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।
তদন্ত রিপোর্ট কবে নাগাদ প্রকাশ হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই রিপোর্টের কার্যক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে। কার্যক্রম বাস্তবায়ন শেষ হলে জানানো হবে। এখানে অনেক আইনগত বিষয় আছে, যা দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে রিপোর্ট প্রকাশের ফলে কেউ যদি আদালতে গিয়ে অভিযোগ করে তাহলে আরও বড় সমস্যায় পড়তে হবে। ইতোমধ্যে আমরা দুটি আইনি জটিলতার মধ্যে আছি।
জেএন/এমএইচএস