অ্যালগরিদমের দাসত্বে আটকে সোশ্যাল মিডিয়া কি আমাদের জম্বি বানাচ্ছে?
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১৯:১২

চারপাশে তাকাও— বাসে, রাস্তায়, অফিসে, এমনকি পরিবারের টেবিলে বসে থাকা সদস্যদের মাঝেও। কারও চোখে চোখ পড়ে না, কারও কণ্ঠে আর প্রাণ নেই। শুধু একটাই জিনিস সবার হাতে মোবাইল ফোন। আর তার ভেতরে ঘূর্ণায়মান রিল, স্টোরি, নিউজ ফিড। আমরা যেন সবাই এক অদৃশ্য ঘূর্ণিপাকে আটকে গেছি— তার নাম ‘সোশ্যাল মিডিয়া’।
আজকের মানুষ নিজের চিন্তায় নয়, বরং নোটিফিকেশনের আওয়াজে জেগে ওঠে, ঘুমায়। যেখানে আগে ভোরে মানুষের ঘুম ভাঙত পাখির কিচির মিচির শব্দে, এখন দিনের শুরু হয় দেখে কে নতুন পোস্ট দিয়েছে এবং শেষ হয় লাইক গুনে। আমাদের মস্তিষ্ক এখন যেন অ্যালগরিদমের নির্দেশে চলা এক যান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। কোন বিষয়গুলোতে আমরা রাগব, কাঁদব বা হাসব— সব কিছুই নির্ধারণ করছে একটি কোড, কিছু ডেটা, কিছু কর্পোরেট কোম্পানির লাভের হিসাব।
প্রতিদিন শত শত বিজ্ঞাপন আমাদের সামনে আসে। বিজ্ঞাপনগুলো বলে দেয়, তুমি কেমন দেখতে হবে, কী পরবে, কীভাবে হাসবে, এমনকি কাকে ভালোবাসবে। আমরা ভাবি, আমরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। কিন্তু আসলেই কি তাই? নাকি আমরা একে একে ‘অ্যালগরিদমিক জম্বি’ হয়ে যাচ্ছি?
ভাবো, আজ দুপুরে তুমি হয়তো দুঃখিত ছিলে। পুকুরপাড়ে গিয়ে নিজেকে অনুভব করার চেষ্টা করছো। সোশ্যাল মিডিয়া সেই দুঃখ বুঝে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে ফিডে পাঠিয়ে দেয় একের পর এক মোটিভেশনাল রিল, দুঃখভরা গান, কিংবা সম্পর্ক ভাঙার গল্প। যেন কেউ তোমার ভেতরের আবেগকে টেনে নিয়ে খেলছে। এটা কাকতাল নয়, বরং এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রোগ্রামিং।
আগে মানুষ গল্প করত, গান গাইত, বই পড়ত, ভাবত। এখন মানুষ স্ক্রল করে, লাইক দেয়, শেয়ার করে। আমাদের চিন্তা এখন আর নিজের নয়— একটি অদৃশ্য মায়াজালে আটকে গেছে। যেখানে থেকে বেরোনো প্রায় অসম্ভব।
একসময় মানুষ বইয়ের পাতায় খুঁজত মুক্ত চিন্তার আলো। আজ সেই আলো হারিয়ে গেছে স্ক্রিনের আলোয়। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো আমরা এই ‘জম্বিফিকেশন’-কে স্বাভাবিক মনে করি। মনে হয়, এটাই আধুনিকতা। কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে হারাচ্ছি মানবিক সংযোগ, কৌতূহল, ধৈর্য— সবচেয়ে বড় কথা, চিন্তার ক্ষমতা।
আমাদের মস্তিষ্ক এখন বিজ্ঞাপনদাতা, ব্র্যান্ড এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের জন্য এক ‘ডেটা মাইন’। তারা জানে আমরা কখন কী খাই, কার সাথে কথা বলি, কীয়ে আগ্রহী। তারা জানে কখন আমাদের মন দুর্বল হয়, আর তখনই তারা আমাদের কিছু বিক্রি করে দেয়— পণ্য, ধারণা, এমনকি মতাদর্শও।
তাহলে প্রশ্ন হলো, আমরা এখন আসলে কাদের নিয়ন্ত্রণে আছি— নিজের, নাকি অ্যালগরিদমের?
এটা সময় নিজের কাছে ফিরে আসার। এই কোডিং সিস্টেমের স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা দরকার। বাস্তব আলোয় মুখ তোলো, বাতাসে নিঃশ্বাস নাও, কারও চোখে তাকাও— সত্যিকারের মানুষটাকে খুঁজে বের করো। কারণ যদি এখনই না জাগি, তাহলে হয়তো খুব দেরি হয়ে যাবে। আর তখন সত্যিই মানুষ আর থাকবে না— থাকবে শুধু চলমান ‘জম্বি’দের ভিড়।
এমএইচএস