Logo

আলোর মিছিল

খিলক্ষেত ফুটওভার ব্রিজে বিশ্ব-বেহায়াদের মহোৎসব ও আমাদের ভাঙা স্বপ্ন

Icon

জাহিদ ইকবাল

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫৮

খিলক্ষেত ফুটওভার ব্রিজে বিশ্ব-বেহায়াদের মহোৎসব ও আমাদের ভাঙা স্বপ্ন

প্রতীকী ছবি (এআই দিয়ে তৈরি)

খিলক্ষেত ফুটওভার ব্রিজ। ঢাকার বুকে এক ব্যস্ত ধমনী, যেখানে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ যাতায়াত করে। অথচ, এই অতি গুরুত্বপূর্ণ জনপথটি আজ পরিণত হয়েছে এক 'লজ্জার মঞ্চে', এক অন্তহীন 'চোর-পুলিশ' খেলার অনিয়মিত আসরে। পথচারীর অবাধ চলাচলের অধিকার, একটি জনবহুল এলাকার শৃঙ্খলা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা— সবকিছুই যেন এই সামান্য ওভারব্রিজের নিচে চাপা পড়ে মুখ লুকাচ্ছে। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে কানে বাজতে থাকে ১৬ আগস্টের সেই ওপেন হাউজ ডে-এর প্রতিধ্বনি— যেখানে শত শত মানুষ একটাই দাবি তুলেছিলেন : ‘খিলক্ষেত ওভারব্রিজ বাস স্ট্যান্ডকে হকার ও ভিক্ষুক মুক্ত করুন!’

পরিবর্তনের প্রত্যাশা যখন নিছক স্বপ্নকথা
৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে আমরা যখন পরিবর্তনের এক সোনালী স্বপ্নে বিভোর ছিলাম, তখন বুক বেঁধেছিলাম এক নতুন, সুশৃঙ্খল বাংলাদেশের আশায়। আমরা ভেবেছিলাম, এবার প্রশাসন জনগণের প্রত্যাশাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে। ভেবেছিলাম, পুরনো দিনের সেই ‘যেমন চলছে চলুক’ মানসিকতা থেকে মুক্তি মিলবে। নিকুঞ্জে খিলক্ষেত থানা পুলিশের উদ্যোগে আয়োজিত সেই 'ওপেন হাউজ ডে' আমাদের আশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। হাজারো মানুষের সামনে খিলক্ষেত বাস স্ট্যান্ডকে 'হকার ও ভিক্ষুক মুক্ত এলাকা' ঘোষণার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে খবর প্রকাশিত হয়।

কিন্তু হায়! বাংলাদেশের বাস্তবতার কাছে সেই ঘোষণা যেন এক নিছক 'স্বপ্নকথা' হয়ে রইল। এলাকাবাসী হতাশার সঙ্গে দেখছেন, সেই ‘বিশ্ব বেহায়া’ হকার ও ভিক্ষুক গোষ্ঠী, যাদের উচ্ছেদের জন্য জনমানুষ এত আকুল, তারা এক মুহূর্তের জন্যও পিছু হটেনি। পুলিশের একটি 'টোকেন অপারেশন' হলেই তারা উঠে যায়। কিন্তু অভিযান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই— ঠিক যেন মৌমাছির ঝাঁকের মতো— তারা পুনরায়, সগৌরবে এবং লজ্জাহীনভাবে ওভারব্রিজ ও ফুটপাত দখল করে বসে। এই দৃশ্য দেখে এলাকাবাসীর মনে প্রশ্ন জাগে : এটি কি কোনো সমাধান, নাকি শুধুই লোক দেখানো প্রহসন? ভুক্তভোগী তো একমাত্র সাধারণ পথচারী ও এলাকাবাসী।

যখন পুলিশও অসহায়ত্বের কথা জানায়
সবচেয়ে মর্মস্পর্শী দিকটি হলো, এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও খিলক্ষেত থানা পুলিশের কাছে স্থায়ী ও কার্যকর সমাধানের অনুরোধ করা হলে, তাদের কাছ থেকে আসে এক অপ্রত্যাশিত উত্তর— ‘আমরা অসহায়। আপনারা (এলাকাবাসী) সবাই মিলেই এগিয়ে আসুন।’

এই কথাগুলো শুনে বুক ভেঙে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে দেশের চিত্র। যে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের অপারগতার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে, সেই দেশের সাধারণ মানুষ ভরসা রাখবে কার ওপর? জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার মৌলিক দায়িত্ব যাদের, তারা যখন ‘অসহায়ত্বের বুলি’ আওড়ান, তখন ভুক্তভোগী জনমানুষের কাঁধে কে দেবে আশা-ভরসার হাত? তাহলে কি ধরে নেব, জনদুর্ভোগ লাঘব করার ন্যূনতম দায়িত্ববোধটুকু এই প্রশাসনিক কাঠামোয় অবশিষ্ট নেই? নাকি এই অপারগতার আড়ালে লুকিয়ে আছে কোনো ‘অদৃশ্য শক্তির’ হস্তক্ষেপ, যার কাছে প্রশাসনের হাত-পা বাঁধা?

অভাগা দেশ, অভাগা আমরা সবাই
খিলক্ষেত ওভারব্রিজ আজ শুধুমাত্র একটি অবৈধ দখলের স্থান নয়, এটি আমাদের সামগ্রিক প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং ব্যর্থতার প্রতীক। এই দৃশ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, গতানুগতিক যে ধারায় বাংলাদেশ ছিল— সেই ধারাতেই আমরা আছি। পরিবর্তন হয়নি অফিস, আদালত, থানা-পুলিশ কিংবা জনসেবার মানসিকতায়।

যে কোনো সুস্থ সমাজে, জনগণের সম্মিলিত দাবির মুখে প্রশাসন দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু আমাদের দেশে দাবি ওঠে, প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। এই অব্যবস্থা, দায়বদ্ধতার অভাব আমাদের সমাজকে ক্ষয় করছে।

খিলক্ষেতের পথচারী অসহায়ভাবে মাথা নিচু করে চলতে গিয়ে কেবল অনুভব করে, আমরা সবাই অভাগা। এই জন্মভূমিতে যে যেভাবে পারে বেঁচে থাকে। আইন, শৃঙ্খলা ও অধিকারের কথা এখানে কেবল বইয়ের পাতায় লেখা।

যদি সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হয়, ফুটপাত ও ওভারব্রিজ জনমানুষের জন্য মুক্ত না হয়, তাহলে ওপেন হাউজ ডের মতো অনুষ্ঠান আয়োজনের সার্থকতা কোথায়? প্রশাসনকে নীরবতা ভাঙতে হবে। জনগণের দেওয়া ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত প্রশাসনকে জনগণের সেবায় নিজেদের ‘অসহায়ত্ব’ ঝেড়ে ফেলে স্থায়ী, কঠোর এবং অবিচল পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় পরিবর্তনের স্বপ্ন ভেঙে যাবে, আর খিলক্ষেতের 'চোর-পুলিশ' খেলা চলতেই থাকবে— আমাদের সকল অধিকারকে পদদলিত করে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সমাজকর্মী

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ঢাকার খবর

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর