Logo

জীবনানন্দ

অঞ্জলি লহো হে ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ

মেহেদী হাসান শোয়েব

মেহেদী হাসান শোয়েব

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫, ২০:৫০

অঞ্জলি লহো হে ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ

ছবি : এআই ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে।

বাংলা সাহিত্য যখন রবীন্দ্র-আলোর দীপ্তিতে ভাসছে, তখন বজ্রনিনাদে আবির্ভূত হন একজন, ঝাঁকড়া চুলের উচ্ছল বাবরি দুলিয়ে—তাঁর চোখে দিগ্বিজয়ের আগুন। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। কাব্যের ছন্দে, গানে, গদ্যে ও চিন্তায় তিনি যেন সৃষ্টি ও ধ্বংসের অনন্য যুগলবন্দি। কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেন—

‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,/
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!’

এই উচ্চারণে প্রকাশিত হয় আত্মবিশ্বাসী এক নতুন জাগরণের বার্তা। ভাষার শৈলী যেমন চমকে দেয় সমকালকে, তেমনি যুগবোধের প্রবল ঝাঁকুনি সঞ্চারিত হয় পাঠক-শ্রোতার মনমগজে। নজরুল বাংলা সাহিত্যে দুর্বার উত্তাল এক নদীর মতো—স্রোতপ্রবাহে ভাসিয়ে নিয়ে যান জমে থাকা স্থবিরতা, গোঁড়ামি আর শ্রেণি-ভেদের দেয়াল। তিনি নিজেই যেন এক আন্দোলন। নজরু যেমন স্নিগ্ধ সুরস্রষ্টা, তেমনি যেন সংঘাতের উত্তাল ধ্বনি।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের তুলনা যদিও অনিবার্য নয়, তবে দুই ধারার পরিপূরকতা বাংলা সাহিত্যকে এনে দিয়েছে সম্পূর্ণতা। রবীন্দ্রনাথ আলোর স্থপতি, শান্ত নদীর মতো; আর নজরুল আগ্নেয়গিরি, বজ্রের গর্জন। তিনি একা দাঁড়িয়েছেন ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে, সামন্ততান্ত্রিক সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে। তাঁর কবিতা বিপ্লবের মুখপত্র হয়ে ওঠা দীপ্তি।

নজরুল এমন এক বিরল স্বর, যিনি কোরআনের বাণী যেমন দিয়ে রচনা করেছেন বিদ্রোহের সুর, আবার গীতা ও বেদের তত্ত্ব টেনেও গেয়েছেন ঐক্যের গান। মানুষে মানুষে সাম্যের বীজ বুনেছেন পঙক্তিমালায়। 

তিনি বলেন—

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম, ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/
কাণ্ডারী বল, ডুবিছে মানুষ—সন্তান মোর মার!’

এই উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের মানবিকতা ও সহানুভূতির কথা বলেন, ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের কথা বলেন। তিনি বলেন, সব মানুষ সমান। মানুষকে ভালোবাসাই মানুষের ধর্ম। 

কিন্তু নজরুলের জীবনের সবচেয়ে করুণ অধ্যায় তাঁর আকস্মিক নীরবতা, ভাষাহীন দীর্ঘ নির্বাক জীবন। সৃষ্টির উন্মাদনায় যে কলম বৃষ্টির মতো ঝরতো, যে তরুণ ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দুলিয়ে ছুটে বেড়াতো দিগ্বিদিক, তিনি একদিন থেমে যান। নিষ্পলক তাঁর চোখে বেজে ওঠে কেবল নিরবতার আর্তনাদ, অশ্রুহীন কান্না। তবু, নজরুল বহ্নিশিখা হয়ে জ্বলতে থাকেন যুগের পর যুগ। প্রতিটি প্রজন্মের দ্রোহ, প্রেম, মানবতা ও বিপ্লবের শাশ্বত প্রতীক হয়ে তিনি থাকবেন অনন্তকাল।

তিনি প্রেমিক—প্রেম যার চোখে আগুন ও অশ্রু দুইই।
তিনি শিল্পী—যার গানে বেজে ওঠে শ্যামা-মায়ের জাগরণ ও ইসলামের শান্তি বার্তা।
তিনি সৈনিক—যিনি রাইফেল ফেলে তুলে নেন কলম, শান দেন শব্দে, কবিতায় বিদ্রোহের স্লোগান তোলেন।
তিনি ভবঘুরে—যিনি কুসংস্কার ও বৈষম্যের প্রাচীর ভেঙে পথ বানান ভবিষ্যতের দিকে।

নজরুল কেবল একজন কবি নন, বরং এক জীবনদর্শনের দিশা। তাঁর জন্মদিনে আজ প্রার্থনা করি—তাঁর মতো হয়ে উঠুক আমাদের কণ্ঠ, কলম আর মনুষ্যত্ববোধ।

জন্মদিনে আমার প্রণতি জানিয়ে বলি—

অঞ্জলি লহো হে ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ,
শঙ্খ বাজায়ে জাগাও আজিকে অন্ধকারের যত বেহুঁশ।

বজ্রকণ্ঠে গাও ধরণিতে নব প্রভাতের নতুন গান,
তোমার নামেই গাইবো সকলে বিভেদ ঘোচানো সাম্য-গান।

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর