
ছবি : সংগৃহীত
সীমানা পেরিয়ে শিল্পের নৌকা ভাসে যখন এশিয়ার হৃদয়ে—তখন জেগে ওঠে সৃষ্টির এক নতুন সুর, এক মিলনের উচ্ছ্বাস। দক্ষিণ কোরিয়ার গুয়াংজু শহরের এশিয়ান কালচার সেন্টারে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো বহুল প্রত্যাশিত আন্তর্জাতিক উৎসব ‘সীমানা ছাড়িয়ে : এশিয়ান পারফর্মিং আর্টসের নতুন ঢেউ ২০২৫’।
এশিয়ার ১১টি দেশ—জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মঙ্গোলিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ এই উৎসবে একত্রে বুনেছে সংস্কৃতির এক রঙিন গাঁথা।
সূচনায় রিদমস অব এশিয়া : সুরের সেতুবন্ধন
উৎসবের প্রথম দিন ‘এশিয়ার ছন্দ’ পর্বে রঙ, তাল ও আবেগের মেলবন্ধনে যেন জেগে ওঠে পুরো গুয়াংজু। একে একে মঞ্চে আসে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দল—নিজ নিজ সংস্কৃতির রঙে, ঐতিহ্যের ছোঁয়ায়। কোরিয়ার ঐতিহ্যবাহী ড্রাম বাজনার গর্জনে মঞ্চ যখন কেঁপে ওঠে, তখন শিল্পের প্রাণে বাজে একটাই কথা—‘শিল্পের কোনো ভৌগোলিক গণ্ডি নেই : এটি প্রতিটি মানুষের অন্তরে প্রাণবন্ত।’ শিল্পের ভাষা যে সার্বজনীন—এই সত্যই যেন প্রতিধ্বনিত হয় প্রতিটি ঢোলে, প্রতিটি পদক্ষেপে।
নৃত্যে বিনিময়, অনুভবে ঐক্য
দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচি ছিল ওয়ার্কশপ ও সাংস্কৃতিক বিনিময়। জাপান, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের কোরিওগ্রাফারদের নির্দেশনায় অংশগ্রহণকারীরা মেতে ওঠেন আধুনিক ও সমসাময়িক নৃত্যের জগতে। একটি মঞ্চ, বহু দেশ, অথচ হৃদস্পন্দন এক—এই বিনিময়ের মুহূর্তগুলোয় সৃষ্টি হয় এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য, যা ভাষায় ধরা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।
ঐতিহ্যের আলোয় পারফরম্যান্স নাইট
তৃতীয় দিনের সন্ধ্যা যেন আলোর সঙ্গে আলাপন। পারফর্মেন্স নাইট — ঐতিহ্যের কণ্ঠস্বর -এ মঞ্চে একে একে উঠে আসে চীনের ফ্যান ড্যান্স, থাইল্যান্ডের হন মাস্ক পারফর্মেন্স, শ্রীলঙ্কার কান্দিয়ান নৃত্য, আর বাংলাদেশের দল “কাথ্যাকিয়া”-র হৃদয়ছোঁয়া পরিবেশনা। লোকনৃত্য, শাস্ত্রীয় ছন্দ ও আধ্যাত্মিকতার মায়ায় গাঁথা “কাথ্যাকিয়া”-র উপস্থাপনা যেন ছিল কবিতার মতোই প্রাণস্পর্শী। এক বিদেশি দর্শক অভিভূত কণ্ঠে বলেন—‘বাংলাদেশি পরিবেশনা আত্মাকে ছুঁয়ে গেল-এটি ছিল বিশুদ্ধ কবিতার গতিশীলতা।’
সমাপনীতে ঐক্যের সুর - শেষ দিনে সমবেত শিল্পীরা , যেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতির স্রোত মিশে যায় একাত্মতার মহাসাগরে। হৃদয় থেকে হৃদয়ে পৌঁছে যায় এক বার্তা—সত্যিকারের শিল্প কখনো সীমান্ত মানে না, তার ডানা ছুঁয়ে যায় আকাশের ওপারে।
ইতিকথা
‘সীমানা ছাড়িয়ে’ কেবল একটি উৎসব নয়—এ ছিল আত্মার এক যাত্রা, অনুভূতির মেলবন্ধন। ভাষা, জাতি বা ভৌগোলিক দূরত্ব পেরিয়ে এখানে মিলিত হয়েছে শিল্পের হৃদস্পন্দন, নৃত্যের স্পন্দন ও মানবতার দীপ্ত আলো গুয়াংজুর সেই উৎসবমঞ্চে আজও যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এক অমলিন সুর— ‘শিল্পই আমাদের সত্যিকারের পরিচয়, যা ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের পরিধি পেরিয়ে মানবতার সীমাহীন মহাকাশে।’
সৈয়দা সাহিদা তিথি : কালচারাল অফিসার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি