Logo

শিল্প-সংস্কৃতি

গদ্য

জনম জনম কাঁদিব কবিতার জন্য

Icon

রায়হান উল্লাহ

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৩০

জনম জনম কাঁদিব কবিতার জন্য

কবিতা কী, কারা কবি, কেনইবা কবি- এমন সহস্র প্রশ্ন পাঠকসহ সমাজের বিভিন্ন মানুষের মনে উদয় হয়। এমনকি লেখক-সাহিত্যিকসহ কবিদের মধ্যেও ভাবের সঞ্চার হয়- কবিতার হালচাল কেমন? কবিদের কী কাজ, কেমন তাদের জীবনাচরণ- এসবও গূঢ় প্রশ্ন। 

কবিতাকে কোনো নির্দিষ্ট ছকে আটকে রাখা যায় না। সময়ের সঙ্গে কবিতার বাঁকবদল হচ্ছে। কবিতা নিয়ে চিরকালই কবিরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যাচ্ছেন। এতে করে কবিতা সমৃদ্ধ হচ্ছে, না রূপ হারাচ্ছে; এ-ও প্রশ্ন। 

ব্যক্তিগত ভাবনা- কবিতা একটি শব্দের সুরলিত ভাব; যা দীর্ঘস্থায়ী হাহাকার কিংবা মাধুর্যতার অবয়ব সৃষ্টি করে। কবিতা না বলা বিষয়। কিন্তু সব কথা কবিতা না। সবাই কবিও না। কবিতা প্রচলিত কাঠামো ধরে লিখতে হবে- এ-ও মনে করি না। এ নিয়ে কোনো অপরাধবোধও নেই। অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও ছন্দবৃত্তের ধারা কেউ না কেউ সৃষ্টি করে গেছেন। এর আগে কি কবিতা ছিল না? কবিতা ঐশীবাণীও না। কবিতা কবির যন্ত্রণা, হাহাকার, সুখ-স্বপ্ন কিংবা জিজ্ঞাসা। ভিন্ন অর্থে কবিতা ঐশীবাণীও। কারণ যেকোনো মহান লেখা উপরের ইশারাতেই লেখা হয়। লিখতে বসলে এর নিয়ন্ত্রণ অন্য একজনের হাতে চলে যায়। 

কবিতা কোনো রীতি মানে না। কিন্তু কবির একটি অঘোষিত রীতি তো থাকেই। লেখার শুরুতে এবং শেষে। কবিতার ঘর-সংসারে অর্থাৎ পুরো জীবনে কবি একটি নিয়ম ধরে এগিয়ে চলেন। এ নিয়মের বাইরে যান না কিংবা যেতে চান না। কাব্যের যন্ত্রণা ধারণ করে জীবন পার করেন। কবিরা বলে গেছেন, জানা কথা আবারো বলছি- একটি জীবনের বিনিময়ে কবি হন একজন। এটি হেলাফেলার বিষয় নয়।

কবিরাও ফেলনা না। বরং তারা ঈর্ষণীয়। ঈর্ষণীয় মানুষ কেমন থাকেন? সমাজ তাদের কেমন রাখে, এসব কথাও আসে। সময়-সভ্যতা, দেশ-কাঠামোর ওপর নির্ভর করে কবিরা কেমন থাকবে? কবিরা দেশ-কাল-পাত্রভেদে যেমনই থাকুক তারা বিচ্যুত নন। বরং তারা নিজেকে নিয়েই খুশি। একটি ভাবাতুর জীবন তারা পার করেন। কবিতার সংসার করেন। কবিতা তাদের কাছে অনেক প্রিয়। ফলে সুখেই থাকেন তারা!

প্রকৃত কবিদের জীবন চিরকালই হাহাকারে পূর্ণ থাকে। জন্ম থেকেই বোধের সংসারে প্রতিনিয়ত টোকা দেন তারা। দৈবিক ছলাকলা শেখা হয় না তাদের। অর্থ-বিত্তও কামানো হয় না। কাব্য গড়ে যান তারা। একটি পরম ঈর্ষণীয় কবিত্ব শক্তি আছে তাদের। আর কিছু চান না তারা। 

অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কবিদের আমরা বেঁচে থাকতে চিনি না। তাদের প্রকৃত মূল্যায়ন জীবদ্দশায় হয় না। বরং জীবন তাকে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা দেয়। এতে কবির লাভই হয়। তিনি সময় পরম্পরায় কবি হয়ে উঠেন। গিলে চলেন শহর, কবি কাব্যের যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে হেঁটে চলেন। আধুনিক সভ্যতারা কবিকে মশকরা করে, জুতার শুকতলি প্রহসন করে, পকেটের অর্থ ফিসফিস করে, ঘরের বউ শিহরণ তোলে, রাজপথ জিঘাংসা গড়ে, কবি শিরদাঁড়া সোজা করে এগিয়ে যান। তাকে এতসব দেখলে হয় না। বেশি কিছু ভাবনাও নেই তাদের। যতসব ভাবনা কবিতাকে ঘিরেই। তাই কবি বাজার করতে গিয়ে বিশ্ব সংসার চরাচর ঘুরে আসেন। ফুল-লতাপাতা আঁকা ট্রাংক নিয়ে নগর-সভ্যতা ধরে এগিয়ে চলেন। ধরাধামের সব নদীর জলে গা ভেজান। তিতাস-লাহোর ছুঁয়ে টেমসের মানুষকে ধরতে যান। বিশ্বজুড়ে শুধু মানুষ জমান। আর ওইসব মানুষ প্রকৃত মানুষ চেনেন না। অবহেলা কিংবা বেলা-অবেলা বয়ে যায়। কবির দেখা পান না তারা। একদিন সব সাঙ্গ করে বিদায়বেলার ঘণ্টা বাজে। দলে দলে শোরগোল ওঠে; কবি আর ফেরেন না। 

কবিতাকে যেমন কোনো ছকে বাঁধা যায় না, কবিদেরও না। তারা কোনো কাঠামো-শৃঙ্খল মানেন না। শৃঙ্খল বা শিকল ভাঙার গানই তারা গান। যুগ যুগের যত অনিয়ম, যত রুদ্ধতা কবিদের দ্বারাই ভেঙেছে। তারা কোনো সীমানা মানেন না। কোনো সময়ের নন তারা। সবকালে, সব সময়ে চিরমুক্তির গান গেয়েছেন তারা।

এমন ঈর্ষণীয় মানুষের রাষ্ট্র বা সময়-সংসার কেমন রেখেছে। ভালো রাখেনি। জীবদ্দশায় তারা অবমূল্যায়িত। সব লুটে যায় অন্য, কবির পকেট শূন্য। কবিদের কি তাতে কিছু যায়-আসে? কবি ছুটে যান সূর্যকে সাথী করে। পাশে পড়ে থাকে যাপিত সময়, অহমের জীবন। আরো পড়ে থাকে আজন্ম দুঃখ, ব্যথাতুর ক্ষরণ, কাব্যের গড়ন। কথা সাজে- তিনি ছিলেন, অক্ষরের আদল বলে এখনো আছেন; চিরকালই রবেন। কবিরা হারান না। হারিয়ে যায় আপাত জীবন, ক্ষণিকের বরণ, আপেক্ষিক মরণ। কবিরা বিলীন হন না। কবিতার পড়তে পড়তে জীবনবোধ ছড়িয়ে দিয়ে বেঁচে থাকেন তারা। এভাবেই আজীবন জীবনবোধে শিহরণ তুলেন তারা। তাইতো যত কৃষ্টি ও সৃষ্টি কবিদের গড়া। সব সৃষ্টির আহার কবিতা। সব রেনেসাঁর মূলে কবি ও কবিতা। আরো এগিয়ে প্রশ্ন করা যায়- বিশ্ব চরাচরের কোন বিষয়-আসয়ে নেই কবিতা? কবিরা রাজা, রাজ্য তার কবিতা।

কবির কবিতার রাজ্যে সবই থাকে; দুঃখ, সুখ, নারী, দেশ, মানুষ। কবিরা অক্ষরের ব্যঞ্জনা গড়েন। সমৃদ্ধ পৃথিবী ধরেন। ভালোবাসার বাক্স ভরেন। কবিদের তরে, কবিদের জন্য সব সৌন্দর্য-সৃষ্টি অপেক্ষা করে। মনের আয়নায় ভাষার বাঙ্ময়তায় সৃষ্টির সৌন্দর্য তুলে আনেন তারা। পৃথিবী যাপনের ডায়েরি গড়েন। কালের অক্ষরে লিখে যাওয়া সুরলিত গান থাকে আগামীর জন্য। সভ্যতার মুখোমুখি হই আমরা। কবির অভিব্যক্তি সময়ের পাথেয় হয়।

আসলে কবিতার রসে কবির তৃষ্ণা মেটে। কবিতাতেই কবির আশ্রয় মেলে। কবিতার পরশে পরাণ জুড়ায়। কবিতাই যেন কবির জীবনের লেনাদেনা। কবিতাতেই কবি খুঁজে ফিরেন সব। এমনকি খুঁজে যান খোদ স্রষ্টাকে। কবি কখনো হীনম্মন্য হন না। কবি যেন একটি আখ্যান।

কবিরাও মাঝে-মধ্যে কান্না করেন। তাদের কান্না আমরা ধরতে পারি না। আবার তাদের কান্না ঠিক ধরাও যায় না। কবিদের কান্না কবিতা হয়ে আসে। প্রসব বেদনায় ছটফট করেন কবি। কবির কান্না অন্য সবার কান্নার সঙ্গে মেলে না। 

কবিরা বিবাগী হন। কবিতার চিরকালীন প্রেমী হন। বিশ্ব সংসার চরাচর তুচ্ছ করে এগিয়ে যান কবিতার তরে। জীবন ও মানুষ কবিদের তরে সকৌতুক করে। কবির তাতে হয় না কিছুই। ভালোবাসার তরে কবিতার জঠরে বীজ বুনেন কবিরা। ফলে একদিন মৃত্যুর পালকি আসে। মাটিকাব্য শেষ হয়। অন্যঘরে সংসার হয়। কিন্তু ইথারে থেকে যায় কথামালা। তিনি ছিলেন, সবার তরে। তানপুরায় গান ছিল, জোছনার বান ছিল। ব্যাঙের ব্যঞ্জনা ছিল। বৃষ্টির লহরি ছিল। বৃষ্টিকাব্যও ছিল। সবকিছু সাঙ্গ করে কবি যখন অচিনপুরে। রয়ে যায় তার এপিটাফ; কবিতা হয়ে। কবিতার তরে পুরো একটি জীবন খরচ  করে সৃষ্টির নিগঢ়ে রয়ে গেছেন কবি।

কোনো দুঃখবোধ নেই, কোনো হাহাকার নেই। যা কিছু খেদোক্তি, ভবের মাঝারে আলোর প্রজ্জ্বলন সব কবিতার জন্য। কবিতা কখনো মানুষ হয়েছে, কখনো নদী হয়েছে, কখনো প্রকৃতি, কখনো পাহাড়-ঝরনাধারা, কখনো উপজাতীয় গোধূলি, কখনো মৃত্যুর মিছিল; আবার কখনোবা নাগরিক ফুটপাত হয়েছে। এভাবেই সব রূপে মিশে যায় কবিতা। প্রাণের সংহার কিংবা গড়া। সব হয় কবিতার রূপ-ছায়ায়। কবিতার আকাশে গোধূলির সমীরণে কবি ভাবে জীবন, হায়রে জীবন, কবিতার জীবন; আরেকটু বেশি হলে মন্দ হতো না। কবি ও কবিতার আক্ষেপ চিরকালীন। পুনর্জন্মেও যেন কবিতা হাত ধরাধরি করে হাঁটে। আক্ষেপের সুরলিত রব- জনম জনম কাঁদিব কবিতা তোমার জন্য।

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

কবিতা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর