তাসলিমা রান্নাঘরে বসে মাছ কাটছিল। বড় ঘরের বারান্দায় বসে তার ছেলে-মেয়ে খেলা করছিল। ছেলের বয়স পাঁচ আর মেয়ের বয়স তিন। মেয়ে তিন মাসের গর্ভে থাকতে তসলিমার স্বামী খোরশেদ বিদেশ যায়। মেয়ে এখন পর্যন্ত তার বাবাকে দেখেনি। ছেলে বাবাকে দেখলেও স্মরণ করার মতো স্মৃতি নেই। তারা প্রায়ই মাকে জিজ্ঞেস করে- বাবা কবে আসবে?
তাসলিমা জবাব দেয়-আসবে, খুব শীঘ্রই আসবে। তবে সে জানে তার স্বামী শীঘ্রই আসবে না। অন্তত বছর দেড়েকের মধ্যে তার আসার কোনোই সম্ভাবনা নেই।
হঠাৎ ছেলেমেয়ে দুটি খেলা ফেলে উৎসুক দৃষ্টি মেলে উঠোনে তাকিয়ে রইল। তাসলিমা রান্নাঘর থেকে ছেলেমেয়েদের দেখতে পেলেও উঠোনটা পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছিল না। তাসলিমা বলল- কেউ আসছে বাপ?
ছেলে জবাব দেয়ার আগেই উঠোন থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ বলল- ভাবি, আমি লতিফ। খোরশেদ ভাই কিছু টাকা আর জিনিস দিছে। সেগুলো দিতে আসছি।
তাসলিমা মাছ কাটা ফেলে তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে রান্নাঘর থেকে ছুটে এল। ঘর থেকে একটা চেয়ার বের করে বারান্দায় নামিয়ে দিয়ে বলল- লতিফ ভাই, তুমি কবে আসছো?
-গত পরশু আসছি।
-কিছুই জানি না।
-পাড়ার সবার সাথে দেখাটেখা করলাম। আজ আসলাম আপনাদের এখানে।
-আচ্ছা বসো। আমি চা করে আনছি।
-চা লাগবে না ভাবি।
-চা লাগবে না কেন? এত দিন পরে বিদেশ থেকে আসছো, খালিমুখে কথা বলবো তোমার সাথে?
লতিফ তার হাতের ব্যাগ বরান্দায় নামিয়ে রাখল, কিন্তু সে বারান্দায় উঠে চেয়ারে বসল না। শেষে তাসলিমা চেয়ারটা উঠোনে নামিয়ে দিল। তাসলিমা ঘর থেকে কাপ-পিরিচ, চা-পাতা, চিনি, বিস্কুট বের করে ছুটে গেল রান্না ঘরে।
চা-নাস্তা নিয়ে এসে তাসলিমা দেখে ছেলেমেয়ে দুটি খুব আগ্রহ নিয়ে বারন্দায় নামানো প্যাকেটগুলো ধরে বসে আছে। তাসলিমা বলল- তোমাদের বাবা পাঠিয়েছে। তারপর লতিফের উদ্দেশ্যে বলল- এতে কী আছে লতিফ ভাই?
-বাচ্চাদের খেলনা, কিছু খাবার এইসব আছে আরকি।
খেলনার কথা শুনে ছেলেমেয়ে দুটির চোখে-মুখে হাসির আভা জাগল।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে লতিফ পকেট থেকে একটা লম্বা খাম বের করে বলল- পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠিয়েছে খোরশেদ ভাই।
-সে কবে আসবে সেরকম কিছু বলছে?
-তার আসতে দেরি হবে। কোম্পানি তাকে প্রমোশন দিছে। এখন সে আমাদের সুপারভাইজার। বেতন আর সুযোগ-সুবিধা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো। কোম্পানির মালিক খোরশেদ ভাইয়ের ওপর খুব নির্ভর করে।
স্বামীর প্রশংসা আর উন্নতির খবর শুনে তাসলিমা মনে মনে খুশি হলো। বলল- তোমার কি সব সময় তার সাথে দেখা হয়?
- আমি তো তার আন্ডারেই কাজ করি। পাশাপাশি রুমে আমরা থাকি।
- ভালোই তো।
- খোরশেদ ভাই খুব ভালো মানুষ। তার কারণেই বিদেশে খুব নিশ্চিন্তে আছি।
- বিস্কুট খাও।
তাসলিমা প্যাকেটগুলো খুলল। খুলে খেলনাগুলো ছেলেমেয়ের হাতে দিল। ছেলেমেয়ের আনন্দ আর ধরে না। না দেখা বাবার প্রতি তাদের ভালোবাসা, আস্থা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেল। ছেলেটা বলল- মা, বাবা আসলে আমি বাবার কোলে চড়ব। সঙ্গে সঙ্গে মেয়াটা বলল- আমিও...।
তাসলিমা খিলখিল করে হেসে উঠে বলল- কোলে চড়বে কি, সে তো তোমাদের কোল থেকে নামাবেই না।
এরই মধ্যে লতিফের চা-বিস্কুট খাওয়া শেষ হয়েছে। তাসলিমা বলল- লতিফ ভাই, কতদিনের ছুটিতে আসছো?
- ছুটি একটু বেশিই আনছি- তিন মাসের। ঘরবাড়ি ঠিক করতে হবে তো। বড়ঘরটা পাকা করতেছি।
- তায়লে কি এইবার বিয়া কইরা যাইবা?
- এইবার সেটা হবে না ভাবি। টাকা যা আনছি তার সবটা বাড়িঘর ঠিক করতেই খরচ হয়ে যাবে। বিয়াতে তো খরচ কম না। কাপড়-গহনা, আসবাবপত্র, মেহমান আপ্যায়ন। আগামীবার এসে বিয়া করবো।
- মেয়ে দেখব?
- চেনা-পরিচয়ের মধ্যে যদি ভালো মেয়ে পান তো...।
- কেমন মেয়ে তোমার পছন্দ লতিফ ভাই? উচ্চ শিক্ষিত?
- অত শিক্ষিত দরকার নাই। আমি নিজেই তো উচ্চ শিক্ষিত না।
- টাকা থাকলে মেট্রিক পাস ছেলেও এমএ পাস মেয়ে বিয়ে করতে পারে।
- বংশ, আচার-আচরণ ভালো হলে হবে।
- বিউটি কুইন হতে হবে না...হিহিহিহি?
- সুন্দর শরীরে যতটা না, মনে তার চেয়ে বেশি। মন সুন্দর না হলে শেষ পর্যন্ত শরীরের সৌন্দর্য ভালো লাগে না।
- তা ঠিক বলছো। আচ্ছা, আমি দেখতে থাকি...।
- আজ তাহলে উঠি।
- তোমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে যাও লতিফ ভাই।
১০-১২ দিন পরে। দুপুর।
তাসলিমার ছেলেমেয়ে দুটি ঘুমাচ্ছে। তাসলিমার ঘুম আসছে না। সে ফেসবুক করছে। সাধারণত ছেলেমেয়ে জেগে থাকলে সে ফেসবুক করার সময় পায় না। ছেলেমেয়ে ঘুমালেই সে ফেসবুকে মজে যায়। অনেকটা নেশার মতো হয়ে গেছে। স্ক্রল করে করে নিউজফিড দেখতে ভালো লাগে। সত্য-মিথ্যা অনেক রকম খবর জানা যায়। নানা রকম ছবি ও ভিডিও দেখে।
দেখতে দেখতে তাসলিমার সামনে চলে এল তিন মিনিটের একটা ভিডিও ক্লিপ। একটা হলিউড সিনেমার নায়ক-নায়িকার রোমাঞ্চের ক্লিপ। বেশ যৌন আবেদনময়ী। ভিডিওটা তাসলিমা তিন/চার বার দেখল। দেখতে দেখতে তার শরীর জেগে উঠেছে। স্বামীর ওপর সে বিরক্ত হলো। টাকা কামানোর জন্য বছরের পর বছর এভাবে বউ ফেলে বিদেশে পড়ে থাকে লোকটা। অন্তত বছরে দুই/এক মাসের ছুটি নিয়ে আসতে পারলেও হতো। দ্ইু/তিন বছর পর পর আসা মোটেও ভালো কথা নয়। সে এই নায়কের চেহারার সাথে লতিফের চেহারার কোনদিক দিয়ে যেন একটু মিল খুঁজে পেল।
ফেসবুক থেকে বের হয়ে কী করবে তাসলিমা বুঝতে পারছিল না। জেগে ওঠা শরীর নিয়ে সে ঘুমাতে পারে না। বিষয়টা ভুলে যাবার জন্য সে সেভ করা ফোন নাম্বারগুলো দেখতে লাগল। লতিফের নাম্বারটা চোখের সামনে চলে এলো।
তাসলিমা লতিফকে ফোন করল- হ্যালো...।
- হ্যালো।
- সেই যে গেলা আর কোনো খবর নাই।
- কে বলছেন?
- কণ্ঠ চিনতে পারছো না?
- ঠিক চিনতে পারছি না।
- চা খাইয়া গেলা অথচ সেই খোরশেদ ভাবিকে ভুলে গেলা?
- ও ভাবি আপনি? আমি আপনার নাম্বারটা সেভ করেছিলাম না। তা কেমন আছেন?
- ভালোই আছি। আর তো খবর নিলা না...।
- আসলে অনেক ঝামেলার মধ্যে আছি ভাবি। বাড়িতে রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি সব এক সাথে কাজ করতেছে।
- বুঝলাম, তোমার অনেক ব্যস্ততা। তারপরেও চেষ্টা করলে আসা যায়।
- আসব ভাবি- আসব।
- কবে আসবা?
- আসব...।
- কালই আসো। কথা আছে। কাল দুপুরে আমার এইখানে খাবার খাইবা।
- তার কোনো দরকার নাই ভাবি। এক কাপ চা হলেই চলে।
- আমি দাওয়াত দিলাম। কাল দুপুরে আমার এইখানে খাইবা। বেশি কিছু করব না। মুরগির সালুন আর ডাল-ভাত।
-হাহাহাহা।
*****
তাসলিমার হাতের রান্না খেয়ে লতিফ অনেক প্রশংসা করল। সত্যিই সে অনেক দিন এত স্বাদের রান্না খায়নি। খাওয়ার পর গল্প করতে করতে তাসলিমা বলল- তা ঘরবাড়ি তো খুব ঠিক করতেছো, বিয়ার জন্য মেয়ে দেখছো নাকি?
- সেটা তো আপনেই দেখতে চাইছেন।
- মেয়ে আমার মতো সুন্দরী হলে চলবে?
-ভাবি, এই গ্রামে আপনার মতো সুন্দরী মেয়ে মানুষ আর একটাও নাই। খোরশেদ ভাইয়ের কপাল ভালো তাই আপনাকে পাইছে। আপনে শুধু সুন্দরী না, গুণবতীও। তো আপনার মতো সুন্দরী খুঁজলে পাওয়া যাবে না সহসা। তাই অত সুন্দর চাই না, মোটামুটি হলেই চলবে। তার সাথে স্বভাব-চরিত্র আর কাজেকর্মে ভালো হলেই হবে। বুঝেন তো বিদাশ থাকি। মেয়ের স্বভাব চরিত্র ভালো না হলে...।
- তার মানে সুন্দরী মেয়েরা স্বভাব-চরিত্রে ভালো হয় না?
- সে কথা বলি নাই ভাবি। বুঝেন তো আজকাল যা দিনকাল পড়ছে! ফোন, ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক আরও কত কি! মানুষকে স্থির থাকতে দেয় না।
তারপর থেকে নিয়মিতই তাসলিমা লতিফের সাথে কথা বলে। তারা দুজন ফেসবুকেও যুক্ত হয়েছে। রাতে শুয়ে শুয়ে ইনবক্সে চ্যাট করে। অনেক রসরসিকতার আলাপ হয়। লতিফ দু/একদিন পর পরই তাসলিমার এখানে আসে। তার ছেলেমেয়েদের জন্য এটা-ওটা নিয়ে আসে। লতিফের ভেতর কুচিন্তা-কুমতলব না থাকলেও সে তো বয়সি যুবক, যৌবনের উত্তাপ তার শরীর-মনে। সুন্দরী নারীর সাথে গল্প করতে তারও ভালো লাগে। তাসলিমার তীক্ষè স্বরের কথা, ছুরির মতো ধারালো হাসি, ধনুকের মতো শরীরের বাঁক এসব তার ভালো লাগে।
এক দিন নীরব দুপরে লতিফ এলো। বারান্দায় বসে দুজনে গল্প করছিল। গল্প করতে করতে তাসলিমা বলল-বিয়া তো করতে চাও, শরীরে উত্তাপ আছে বইলা তো মনে হয় না।
এ কথায় লতিফ যেন একটু লজ্জা পেল। বলল- উত্তাপ কি আর প্রকাশ করার জিনিস ভাবি? অনেক সময় আগুন ছাই দিয়া চাপা দিয়া রাখতে হয়।
- চাপা দিয়া রাখলেই বুঝি আগুন চাপা থাকে। ঠিকই কখনও না কখনও বাতাস পাইয়া বাইর হয়। সুন্দরী ভাবির সাথে বইসা গল্প করো, অথচ কোনো আভাস পাওয়া যায় না।
- কি যে বলেন ভাবি। আপনাকে আমি সম্মান করি।
- আগুন প্রকাশ হলে কি সম্মানের ঘাটতি হয়?
- ভাবি, আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।
- আসো ঘরে আসো।
তাসলিমার পিছু হেঁটে লতিফ ঘরে গেল। তাসলিমা লতিফকে খাট দেখিয়ে বলল- বসো।
-ভাবি, আমি এখন যাই, অনেক কাজ পড়ে আছে।
- আরে যাবেই তো। বসো।
লতিফ খুব অস্বস্তি আর মনে কিছুটা ভয় নিয়ে বসল। আবার কোনো বিপদ বা ঝামেলায় জড়িয়ে যাচ্ছে কি না। তাসলিমা প্রায় লতিফের গা ঘেঁষে বসে বলল- তোমার খোরশেদ ভাইয়ের বিবেচনাবোধ কম।
- কী ব্যাপারে...?
- ঘরে যুবতী স্ত্রী রেখে বছরের পর বছর বিদাশ থাকে।
- খোরশেদ ভাইকে কোম্পানিতে গুরুত্ব দেয়, এর মধ্যে পটাপট দুইটা প্রমোশন পাইলেন।
- শুধু কোম্পানির কাজই কাজ, জগতে আর কোনো কাজ থাকে না? এই বলে তাসলিমা ঝট করে সরে লতিফের গা ঘেঁষে বসল। লতিফ সরে যেতে গিয়েও পারল না, তসলিমা তার হাত ধরে টান দিয়ে কাছে রাখল।
লতিফ বলল- ভাবি, বাচ্চারা এসে পড়বে।
- বাচ্চারা নানির বাড়ি গেছে।
- ভাবি, এই অবস্থায় লোকে দেখলে আমাদের বিপদ হবে, মহাবিপদ।
তাসলিমা উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে এলো। জানালার পর্দা নামিয়ে দিল। বলল- কেউ কিছু দেখবে না, জানবে না।
- ভাবি, আমি খোরশেদ ভাইকে সম্মান করি, কর্মক্ষেত্রে তিনি আমার বস।
- তিনি তোমার বস, আমি কি তোমার বস? আমি তোমার ভাবি। অত ভালো মানুষের ভাব দেখাইও না। শরীর তোমারও আছে, আমারও আছে। কিচ্ছু হবে না। দুই বছর ধরে...। আমার কষ্টটা বোঝ। তোমার মতো সুপুরুষ...। আসো। আমি তোমার জন্য দোয়া করব, তোমার প্রমোশন হবে।
*****
বাঘ নরমাংসের স্বাদ পেলে অন্য খাবার তার মুখে রচে না। বিড়াল একবার দুধ খেলে, শুধু দুধের গন্ধই শুঁকে বেড়ায়। লতিফের মতো একটা তাগড়া যুবক শত চেষ্টায়ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। সে মাঝে মধ্যেই যেতে থাকে তাসলিমার কাছে। আর তাসলিমার তৃষ্ণার তো কোনো কমতি ছিলই না।
দেখতে দেখতে লতিফের ছুটি শেষ হয়ে গেল। ঠিক তার চলে যাবার তিন দিন আগে দুই সন্তান নিয়ে তাসলিমা বিয়ের দাবিতে লতিফের বাড়িতে হাজির। তাসলিমার দাবি- তার পেটে লতিফের সন্তান। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে লতিফ তাকে অনেকবার ধর্ষণ করেছে।
গ্রামের মানুষ জড়ো হয়ে গেল। নানাজনের নানা কথা।
নারীর প্রতি মানুষের স্বাভাবিক সহানুভূতি জাগল। উচ্চ গলায় অনেকেই তেড়ে গেল লতিফের দিকে-তুমি বিদাশ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে আসছো, বিয়া করে ঘর-সংসার করো। তুমি কেন বিবাহিত মেয়েলোকের কাছে গেলা? তার স্বামী নাকি আবার তোমার বস। বদমাশ লোক তুমি।
বিষয়টা থানা-পুলিশ পর্যন্ত চলে গেল। পুলিশ লতিফকে ধরে নিয়ে গেল। মামলা হলো। লতিফ হাজতে। অনেক চেষ্টায়ও লতিফের পরিবারের লোকজন তার জামিন করাতে পারল না। লতিফের ভিসা বাতিল হয়ে গেল।
অবশেষে লতিফ তাসলিমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে জামিন পেল।
লতিফের আর বিদেশ যাওয়া হয়নি। সে তাসলিমার সাথে সংসার করছে। ছোট একটা ব্যবসা করছে। তার নিজের সন্তান পৃথিবীতে আসার সময় খুব নিকটে। খোরশেদের সন্তান দু’টিকেও সে নিজের সন্তানের মতোই দেখে। খোরশেদ কিছু জানে না নিশ্চয়। কারণ সে এখনও তাসলিমার নামেই যথারীতি টাকা পাঠাচ্ছে। হয়তো বিদেশে বসে এই খবর পেলে খোরশেদ বাঁচতে পারবে না তাই তার বাবা-মা তাকে খবরটা দেয়নি। খোরশেদ তাসলিমাকে ফোন করলেও তাসলিমা স্বাভাবিকভাবে কথা বলে, ছেলেমেয়ের খবর দেয়।
খোরশেদের যা সর্বনাশ করার তা তো সে করেছেই, খোরশেদের পাঠানো টাকাগুলো তাসলিমা খোরশেদের বাবা-মার কাছে পৌঁছে দেয়। তারা অবশ্য খোরশেদের সন্তানদের ভরণপোষণ বাবাদ কিছু দেয়। তা না দিলেও বাচ্চারা কষ্ট পেত না। লতিফ শিশু দুটির কোনো কষ্ট হতে দিত না।
রাত বারোটার বেশি বাজে। লতিফের চোখে ঘুম আসছে না। তাসলিমা বলল- তুমি ঘুমাইতেছো না ক্যান?
- ঘুম আসতেছে না।
- ঘুমাও। সকালে দোকান খুলতে পারবা না।
তখনই খোরশেদের ফোন এলো- লতিফ, তোর খবর কী ভাই? খোরশেদ লতিফকে সব সময়ই ভাই সম্বোধন করে।
লতিফ বলল- এই তো আছি...।
- কোম্পানি তো তোর নিয়োগ বাতিল করে দিছে। কেমনে কী হইল কিছুই বললি না। এত ভালো চাকরিটা হারাইলি। তুই যদি আসিস তো আমি নতুন করে কোম্পানির সাথে কথা বলতে পারি।
লতিফ চিৎকার করে কেঁদে উঠল- খোরশেদ ভাই, আমি তো বাঁইচা নাই, আমি মারা গেছি।
- কী হয়েছে আমাকে খুলে বল। তুই আমার ছোট ভাইয়ের মতো। তোর যে কোনো সমস্যা আমি দেখবো। বল কী হয়েছে?
- খোরশেদ ভাই, আমি মারা গেছি। আমার একটা সন্তান তোমাকে দিয়া গেলাম। তুমি তাকে নিজের সন্তান হিসাবে লালন-পালন কইরো। শিশুটা তো নির্দোষ।
- তোর কথার মাথামণ্ডু আমি কিছুই বুঝতেছি না।
লতিফ আর কিছু বলতে পারল না। সে ফোন কেটে দিয়ে শিশুর মতো কাঁদতে লাগলো। তাসলিমা বলল- তুমি কি পাগল হইছো? যা হওয়ার হয়ে গেছে। তুমি তোমার মতো ভালো আছো। সে দেশে আইসা আরেকটা বিয়া কইরা নেবে। ঘটন-অঘটন নিয়াই মানুষের জীবন। তুমি বাঁইচা নাই মানে? আজেবাজে কথা কী বলো?
সকালের সূর্য অনেক দূর এগিয়ে গেল তবু লতিফ ঘুম থেকে ওঠে না। প্রথমে তাসলিমা মনে করেছিল, রাতে ভালো ঘুমাতে পারেনি, কান্নাকাটি করেছে তাই ঘুম ভাঙছে না। কিন্তু বেলা যখন বেড়েই যাচ্ছে তখন তাসলিমা ডাকল- কী ব্যাপার? আইজ কি দোকান খুলবা না?
লতিফের কোনো সাড়াশব্দ নাই। তাসলিমা লতিফকে ধাক্কা দিয়েই চমকে উঠলো। দেখে লতিফের দুই ঠোঁট নীল হয়ে গেছে। মুখের চারপাশের ফেনা শুকিয়ে গেছে। তার মাথার কাছে একটা কাগজ- মানে চিরকুট, তাতে লতিফের হাতের লেখা সবাই চিনল। লতিফ লিখেছে-
আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না। খোরশেদ ভাই, আমি যে অপরাধ করেছি তুমি আমাকে ক্ষমা কইরো না। তুমি তাসলিমা ভাবিকে ক্ষমা করে বুকে তুলে নিও। তোমার সন্তানদের সাথে আমার সন্তানটাকেও তুমি লালন-পালন কইরো। প্রতিটা শিশুই নির্দোষ। আমার অপরাধ নিয়ে আমি চলে গেলাম। মনে রাখবা- ঘটন-অঘটন নিয়েই মানুষের জীবন।

