বাড়ির ছেলে বা মেয়ে যারই বিয়ে হোক না কেন সারাবাড়ি এবং পাড়াময় উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে যেত। অমুকের মাইয়া বা পোলার বিয়া, বলাবলি করতো। কন্যার বাড়িতেই হতো যতো আয়োজনের ঘনঘটা। বর-কনে উভয় পক্ষের মধ্যস্থতাকারী যিনি থাকেন, তাকে বলে ঘটক। তিনি এলাকা বা গ্রামের সত্য-মিথ্যার মিশেলে অধিক কথা বলার একজন মানুষ। ঘন ঘন পান খাওয়া, একটা ব্যাগ বগলের নিচে, সাদা পাঞ্জাবি, টেট্রন কাপড়ের সাদা লুঙ্গি পরনে, কালো ছাতাটা সাথে- তিনিই ঘটক। কনে দেখার পর পছন্দ হলে উভয় পক্ষ বসে বিয়ের দিন সাব্যস্ত করেন। অবস্থাভেদে ছেলে পক্ষ হয়তো ছেলের জন্য একটা সাইকেল, একটা রেডিও বা টেপরেকর্ডার চাইতো। মেয়ে পছন্দ সাপেক্ষে পাকা কথা দিতে পানচিনির ব্যবস্থা হতো। মিষ্টি ও পান সুপারিসহ মেয়ের বাড়িতে এসে বিয়ের পাকা কথা হতো। বিয়ের তারিখ হতো দু’পক্ষের সম্মতিতে। বিয়ে উপলক্ষে কনে ও বরের বাড়ি সাজানো হতো।
বাড়ির চারপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার, আস্ত কলাগাছ কেটে এনে বাড়িতে ঢোকার রাস্তার দুইপাশে কোঁপে কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে গেট বানানো হতো। লাল, নীল, বেগুনি ও হলুদ রঙের কাগজ তিন কোণা ত্রিভুজের মতো কেটে পাটের সুতলিতে আঁটা দিয়ে লাগিয়ে দিয়ে বাঁশের খুঁটির সাথে বেঁধে বেড়া দিয়ে দিতো। জামাই ঢুকতে তার গেটপাস কত টাকা দিতে হবে, তা কাগজে লিখে গেটে ঝুলিয়ে রাখতো মেয়েপক্ষের ছেলে মেয়েরা। ছোটবেলায় দেখেছি, জামাই আসতো সেই গভীর রাতে। আমরা ছোটরা আম্মাকে বলে রাখতাম, জামাই আসলে ডাক দিয়ে ঘুম থেকে উঠাতে। ঘুম থেকে উঠে পানিতে চোখ ধুয়ে নিতাম আমরা ছোটরা। দৌড়ে যেতাম গেটে। জামাই তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়, মুরুব্বিসহ সারা রাস্তা লুঙ্গি পড়ে এসে শ্বশুরবাড়ির আগে কোথাও বিয়ের পাঞ্জাবি পড়ে নিতো।
তখন নীল, হলুদ, লাল এমন বিভিন্ন রঙের ট্রাংক পাওয়া যেতো। ট্রাংকে থাকতো বিয়ের বাজার বা অন্যান্য জিনিসপত্র। আর্থিক অবস্থাভেদে ট্রাংকের বদলে চামড়ার সুটকেসও ব্যবহার হতো। আগে থেকেই বাড়ির কাজের বছরি মুনি ছেলেকে পাহারায় রাখা হতো গেটে টেবিল পেতে। জামাই আসার খবর পেলেই ছেলেমেয়েরা গেটে এসে দাঁড়িয়ে যেতো। জামাইকে গেটে আটকানো হতো। চিনি-লেবুর শরবত খাওয়ানো হতো জামাইকে। শরবতে ঠাট্টাচ্ছলে লবণ কিংবা লাল মরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে দিতো জামাইয়ের শ্যালক শালিকা সম্পর্কীয়রা। জামাইকে গেটে নির্দিষ্ট করা টাকা দিয়ে তারপর ভিতরে ঢুকতে হতো। গেট পাস নিয়ে দু-পক্ষেরই মুখরা ছেলে মেয়েদের তুমুল তর্কাতর্কি চলতো। মেয়েপক্ষ বলতো, ‘মুরাদ নাই ট্যাহা দেওনের/আইছে করতো বিয়া/ছুডুলোহের দল এইতা/বুঝছি জিনিস দিয়া।’ শুনে ছেলেপক্ষ জবাব দিতো, ‘ট্যাহা কি গাছো ধরে/তিন টেক্কেয়া গেইট/পাঁচশো টেহায় যাইতে দেইন/অইয়া গেছে লেইট।’
কোনো পক্ষই হার মানতে নারাজ। জামাই বেচারা গেটে কাহিল অবস্থা। সবশেষে হতো বিয়েবাড়ির মুরুব্বিদের দ্বারস্থ হওয়া। মুরুব্বিরা এসে ছোটদের ধমক দিয়ে মিলিয়ে দিতেন দেনা পাওনার বিষয়টা। জামাই আসার পর ভিতর থেকে মহিলারা গীত শুরু করতেন, ‘দুই হাতে দুই চাঁন্দের বাতি, সারারাতি জ্বলছে, কইনছেন গো জামাই আইতে কেন, এতো দেরি অইছে।’ গেটে শ্লোক বা ধাঁধা দিতো বরপক্ষ কিংবা কনেপক্ষের লোকেরা। উত্তর দিতে না পারলে কথার বাণে অপদস্ত করে মজা করতো। কনেপক্ষ বলতো, ‘জামাই আইছে বিয়া করতো- লগে এরা কিবা?’ উত্তরে বর পক্ষ বলতো, ‘জামাই করবো বিয়া, হে অইলো উবা, আমরা জামাইয়ের শোভা।’ শ্লোক দিতো কোনো পক্ষ, ‘কইনছেন দেহি, এক হাত গাছটা, গোডা ধরে পাঁচটা, যদি গোডা লাল অয়, হাজার ট্যাহার মাল অয়।’ অন্য পক্ষ বলে উঠতো, ‘কইনছেন, কোন মাস্টার স্কুলে পড়ায় না, তারপরেও তারে বেহেই মাস্টার কয়’।
বিয়েবাড়ির গেটের টাকা নিয়ে তুমুল তর্কাতর্কি এমনকি তা ঝগড়া পর্যন্ত গড়াতো। বাড়িতে পটাশ ফোটাতো যুবকরা। টাশ টাশ শব্দ ও আলোয় চারপাশ ফর্সা হয়ে আবার আঁধারে ছেয়ে যেতো। হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে টানিয়ে রাখা হতো উঠানে। কিছুক্ষণ পর পর কেউ একজন হ্যাজাইক লাইট পাম্পিং করতো ঠিকমতো জ্বলার জন্য।
বর-কনের সম্মতিতে আকদ সম্পন্ন হতো। ট্রাঙ্কে করে আনা বরের জিনিসপত্র নিয়ে খোঁচাখুঁচি হতো। এটা ভালে না, ওটা কম দামি, জামাইরা ছোটলোক, কিপটা, এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি, মনোমালিন্য, ঝগড়া পর্যন্ত হয়ে যেতো দুপক্ষের।
এজিন নিতে উকিলসহ মৌলভি সাহেব কনের কাছে যেতেন। বেশ সময় ধরে চুপ থেকে, কান্না দেখিয়ে অনেক্ষণ পর কনে আস্তে করে বলতো ‘কবুল’। কাজি বা মৌলভি সাব বার বার বলতেন, ‘মা কও কবুল, আফনেরা বেহেই হুনছুইন? মেয়ে কবুল কইছে।’- কাবিন ও বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলে বর-কনেকে বড় থালায় খেতে দেওয়া হয়। এটাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলে- সদর ভাতা। শ্যালক-শালিকা, ভাগ্নে, বিয়াই বিয়াইন নিয়ে খেতে বসা হয়। অবস্থাভেদে আস্ত মুরগি ভাজি, পোলাও, ডিম, গরুর মাংস, কোরমা, কাবাব খেতে দেওয়া হয়। সাবান দিয়ে জামাইয়ের হাত ধোয়ায়ে টাকা নিতো ছোটরা। বর যাত্রীদের থাকার জন্য গ্রামের বাড়িতে কাছারিঘরের মেঝেতে ধানের খড় বিছিয়ে বিছানার চাদর দেওয়া হতো।
বালিশের কভারে হাতের সুতোর কাজ করা, লেখা থাকতো- ‘মধুরমিলন, যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভুলে না মোরে।’ আরো কত কী। জগভর্তি শরবত, টিউবওয়েলের ঠান্ডা পানি, নানা পদের পিঠা খেতে দেওয়া হতো। ঘরের পাটশোলার বেড়া থাকায় আঙুল দিয়ে বেড়া ফাঁক করে বাড়ির ভিতর তাকিয়ে থাকতো বরপক্ষের লোকজন, এ নিয়েও অনেক ঝামেলা হতো। বিয়ের সময় কনেকে দেনমোহর কত টাকা দিতে হবে, গেট পাস কত, উভয়পক্ষের কোনো দেনা-পাওনা দাবি আছে কি না, এসব আগে থেকে মিমাংসা করে রাখা হতো না বিধায় বিয়ের দিন দু’পক্ষের তুমুল ঝগড়া হতো। এ নিয়ে বিয়ে ভেঙ্গে দিতেও দেখেছি। আজকাল আকাশ সংস্কৃতির কারণে গ্রামের মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। কলাগাছ পুঁতে বিয়ের গেট হয় না এখন। ডেকোরেশন এসে গেছে গ্রামে। ছেলেরা আগের মতো যৌতুক চায় না।
তারপরও আগের বিয়েতে প্রাণ ছিল। যা করত, মন থেকে, কোনো অভিনয় ছিল না মানুষের মনে। আগে পারিবারিক ভাবে হওয়া বিয়েগুলো জাত, বংশ, পরিবার, আচার-আচরণ দেখে হতো। ফলে বিয়েতে ছাড়াছাড়ি হতো না। জামাই দেখার জন্য রাত জেগে থাকা, পটাশ ফোটানো, গেটে টাকা নেওয়া, জামাইয়ের হাত ধোয়ানো, সেই সাদামাটা কিন্তু প্রাণবন্ত মুহূর্তগুলো আজকের প্রজন্মের মানুষ ডিজিটাল হয়ে মোবাইলে বুঁদ থেকে কোন দিন পাবে না, বুঝবেও না গ্রামীণ সংস্কৃতির এই অধ্যায়টি।

