কথায় বলে, এক মাঘে শীত যায় না। বাংলা এই প্রবাদটি মূলত বিপদের দিক বোঝালেও শীতকাল এভাবে বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে ওতপ্রোতভাবে। আমাদের দেশের প্রতিটি ঋতু নিয়েই কিছু না কিছু লেখা হয়েছে। কবি-গল্পকার এসব ঋতু নিয়ে বহু রচনা হয়েছে, গান হয়েছে। শীতও তার ব্যতিক্রম নয়। শীতের বৈশিষ্ট্যই তো অন্য ঋতুর থেকে ভিন্ন। একেবারে আলাদা। সেই মধ্যযুগ থেকে শুরু করে আজও কবি-সাহিত্যিকরা শীত নিয়ে কম লিখেননি। শীতে কারও প্রিয়ার কথা মনে পড়ে। কারও নিঃসঙ্গ বোধ হয়। শীতকে আমরা যতই জড়তার ঋতু বলি, মূলত শীতেই শরীরের কামোদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (আনু. ১৫৪০-১৬০০) লিখেছিলেন, ‘উদয় পুরিয়া অন দৈবে দিলা যদি/যম-যম শীত তিথি নিরমিলা বিধি/...পৌষের প্রবল শীত সুখী যেজন/তুলি পাড়ি আছারি শীতের নিবারণ/ফুলরা কত আছে কর্মের বিপাক/মাঘ মাসে কাননে তুলি নাহি শাক।’
শীত এলে বসন্ত কি পিছিয়ে থাকতে পারে? শীতের পাতা ঝরা মড়মড় শব্দ শেষে গাছে গাছে সবুজ কচি পাতা জানান দেয় বসন্ত এসেছে। বসন্ত আসতে গেলে শীত তো আসবেই। এ কথাটিই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বিখ্যাত কবি পার্সি বাইশে শেলি। শীতকাল কীভাবে আরম্ভ হয় তা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখিয়েছেন তার ‘দুই দিন’ কবিতায়। কবি দুদিনের জন্য বিদেশে গিয়ে এ দেশের শীতকে উপলব্ধি করেছেন খুব ভালো করেই। কবি লিখেছেন- ‘আরম্ভিছে শীতকাল, পড়িছে নীহার-জাল/শীর্ণ বৃক্ষশাখা যত ফুলপত্রহীন/মৃতপ্রায় পৃথিবীর মুখের উপরে/ বিষাদে প্রকৃতিমাতা শুভ্র বাষ্পজালে গাঁথা/ কুজ্ঝটি-বসনখানি দেছেন টানিয়া/ পশ্চিমে গিয়েছে রবি, স্তব্ধ সন্ধ্যাবেলা/বিদেশে আসিনু শ্রান্ত পথিক একেলা।’
কবিগুরু আবার লিখেছেন, এই-যে শীতের আলো শিহরিছে বনে/শিরীষের পাতাগুলি ঝরিছে পবনে/তোমার আমার মন/খেলিতেছে সারাক্ষণ/এই ছায়া-অলোকের আকুল কম্পনে/এই শীত-মধ্যাহ্নের মর্মরিত বনে- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতাটি শীতের স্পষ্ট প্রকাশ। প্রকৃতিতে শীত এসেছে। শীত বাঙালির অন্যতম প্রিয় একটি ঋতু। কারও কারও কাছে শীত হলো সবচেয়ে প্রিয়। বারো মাসে ছয় ঋতুর দেশ হলো মূলত তিন ঋতুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে আমাদের দেশ। গ্রীষ্ম, বর্ষা এবং শীত। এর মধ্যে শীতের বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে ভিন্ন এবং কাব্যিক। আমরা যদিও বলছি পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস শীতকাল কিন্তু বাস্তবতা হলো এর আগেই প্রকৃতিতে শীতের অনুভূতি ঘটে এবং মাঘের পরেও শীত থাকে। অন্যান্য ঋতুর মতোই প্রকৃতিতে শীতের আগমন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে লেখকের কলমেও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। শীত মানেই যে জড়তা এবং স্থবিরতা বিষয়টা আসলে এরকম না। যদিও সত্যিকার অর্থে প্রকৃতি কিছুটা নীরব থাকে, স্থবির থাকে কিন্তু এই স্থবিরতা এবং জড়তাও কিন্তু সৌন্দর্যের উৎস। এই যে কুয়াশার চাঁদরে প্রকৃতির ঢেকে থাকা, এতেও তো এক সৌন্দর্য নিহিত আছে। স্রষ্টার এ অপার করুণা।
কুয়াশার মতো করে আর বৃক্ষরাশিকে শীতল করতে পারে না কিছু। প্রকৃতিকে বসন্তের জন্য নতুন করে সাজার প্রস্তুতি নিতে সময় দেয়, তাকে তৈরি করে। টিনের চালে রাতভর টুপটাপ কুয়াশা পরার শব্দ আর সকালে ঘাসের ডগায় জমে থাকা কাচের মতো স্বচ্ছ শিশির কণা, এ মুগ্ধতা কেবল শীতেই পাওয়া যায়। এ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অসংখ্য সাহিত্য রচিত হয়েছে। এখনো তো হচ্ছে। কবি গুরুর পরে কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যগ্রন্থের ‘পৌষ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘পউষ এলো গো/পউষ এলো অশ্রু পাথার হিম পারাবার পারায়ে। আবার ‘এইসব ভালো লাগে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন ‘জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে/ আমারে ঘুমাতে দেখে বিছানায়/ আমার কাতর চোখ, আমার বিমর্ষ মøান চুল/ এই নিয়ে খেলা করে: জানে সে যে বহুদিন আগে আমি করেছি কী ভুল/ পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে/পউষের শেষরাতে আজো আমি দেখি চেয়ে আবার সে আমাদের দেশে/ফিরে এলো; রং তার কেমন তা জানে ওই টসটসে ভিজে জামরুল/নরম জামের মতো চুল তার, ঘুঘুর বুকের মতো অস্ফুট আঙুল। কবিগুরু অবশ্য ছড়ার ঢংয়েই শীত ডেকেছেন বাংলার প্রকৃতিতে। তিনি লিখেছেন, ‘কন্কনে শীত তাই/চাই তার দস্তানা;/বাজার ঘুরিয়ে দেখে/জিনিসটা সস্তা না/কম দামে কিনে মোজা/বাড়ি ফিরে গেল সোজা/কিছুতে ঢোকে না হাতে/তাই শেষে পস্তানা। আবার রূপসী বাংলার কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত কবি জীবনানন্দ দাশও শীতকাল নিয়ে লিখেছেন কবিতা। কবি কোনো না কোনোভাবে বাংলার প্রায় প্রতিটি ঋতু নিয়েই কবিতা লিখেছেন। তিনি শীত নিয়ে তার বিখ্যাত ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যে ‘শীতরাত’ কবিতায় লিখেছেন, ‘এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে/বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা/কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।’ কবিতা বা গল্পের পটভূমি চিত্রায়ণে প্রকৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কবি যুগসন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর ‘কাব্য কানন’ গ্রন্থের ‘মানিনী নায়িকার মানভঙ’ কবিতায় লিখেছেন, শীতের বর্ণনায় বসানে ঢাকিয়া দেহ গুঁড়ি মেরে আছি/উহু উহু প্রাণ যায় শীত গেলে বাঁচি/হাসিয়া নাগর কহে, খোল প্রাণ মুখ/শীত-ভীত হয়ে এত ভাব কেন দুখ/ছয় ঋতু মধ্যে শীত করে তব হিত/হিতকর দোষী হয় একি বিপরীত। কবি আল মাহমুদ লিখেছেন- ‘কখনো ভোরের রোদে শিশিরের রেণু মেখে পায়/সে পুরুষ হেঁটে যায় কুয়াশায় দেহ যায় ঢেকে।’ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে প্রার্থনা করেছেন। তিনি তার ‘প্রার্থী’ কবিতায় লিখেছেন- হে সূর্য/তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে/উত্তাপ আর আলো দিও/আর উত্তাপ দিও/রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে। এ ছাড়া কবি আসাদ চৌধুরি ‘সন্দেহ’ কবিতায় শীতের বন্দনা করেছেন এভাবে, ‘চিরল চিরল পাতা বাতাস পাইলে কাঁপে/সাপের মতো লক লকাইয়া চুলার আগুন তাপে/ আমার শীতে দেহ কাঁপে।’ কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতায়ও শীতের উল্লেখ রয়েছে। তিনি ‘নষ্ট অন্ধকারে’ কবিতায় লিখেছেন, ‘আমিও সারা রাত মৃত মানুষের শীতে- শীতার্দ্র হয়েছিলাম-। অর্থবোধ যাই হোক, শীতের সঙ্গে উপমার মিল তো রয়েছে।
অনেকের কাছেই শীত খুব কষ্টদায়ক ঋতু। অনেকেরই শীত উপভোগ্য না হয়ে বিরক্তিকর হয়। শীতের রাতে বৃষ্টির মতো শিশিরের শব্দ শোনা যায়। শীত না এলে কি উষ্ণতা উপভোগ্য হয়? প্রতিটি ঋতুর রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, নিজস্ব ধরন। শীতের বৈশিষ্ট্য একটু বেশিই আলাদা। হেমন্তের শেষেও শীতের অনুভূতি জাগে। কুয়াশা দেখা যায় এবং শিশির পরে। এসব বৈশিষ্ট্য মূলত শীত ঋতুকেই প্রতিফলিত করে। শীত মানেই বাঙালির রসনা তৃপ্তির ঋতু। পিঠা-পার্বণে চারদিক ম ম গন্ধে ভরে ওঠে খেজুরগাছের রস থেকে তৈরি হয় মিষ্টি খেজুর গুড় এবং পাটালি গুড়। এই গুড় থেকে যে পিঠা হয় তা অতুলনীয়, লোভনীয়। হিন্দু সংস্কৃতিতে রয়েছে পৌষ সংক্রান্তি নামের এক পিঠা তৈরি ও খাওয়ার উৎসব। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে পিঠা উৎসব। শীত না এলে এই বৈচিত্র্য কখনোই আসত না।
বাঙালির পিঠা খাওয়া অপূর্ণতাই থেকে যেত। আর পিঠা-পুলি নিয়ে যে সাহিত্য ভাণ্ডার তাও পরিপূর্ণ হতো না কোনো দিন। শীত মানেই তো উৎসব। শীত মানে শুধু উৎসব- এক বাক্যে এটাও বলা যায় না। কারণ তীব্র শীতে দরকার হয় গরম কাপড়ের। শীত অনেকের কাছেই উপভোগ নয় বরং অসহ্য অনুভূতির। যাদের রাত ফুটপাতে কাটে তাদের কাছে শীত অভিশাপ। সেও তো এক রূপ। এ নিয়েও সাহিত্য হচ্ছে। ফলে শীতকে সাহিত্যের অংশে মেলাতেই হবে। সব মিলিয়েই একটি ঋতু বা সময়। এসবকে ধারণ করেই শীত বাঙালির অন্যতম প্রিয় ঋতুতে পরিণত হয়েছে। তাই বলা যায়, জয়তু শীতকাল!

