জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
অব্যবস্থাপনায় অচল কোটি টাকার কম্পিউটার!
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৩০
-68087aef88cb7.jpg)
ছবি : বাংলাদেশের খবর
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) বিভিন্ন বিভাগের কম্পিউটার ল্যাবে অব্যবস্থাপনায় অচল অবস্থায় পড়ে আছে শতাধিক কম্পিউটার। এছাড়া কোনোটির নেই মনিটর, কোনোটির সিপিইউ (সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট)। কোনোটা আবার পুরোপুরি নষ্ট। বর্তমান বাজারে এসব কম্পিউটারের দাম কোটি টাকারও বেশি বলে জানা গেছে। নিয়মিত ব্যবহার না হওয়ার কারণে অচল অবস্থায় পড়ে আছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, একাধিক বিভাগে কম্পিউটার বিষয়ক কোর্স আছে, কিন্তু কম্পিউটার ল্যাব বা কম্পিউটার নেই। অথবা যে কম্পিউটার রয়েছে তা বিভাগের চলমান শিক্ষার্থীদের তুলনায় খুবই সামান্য। আবার ল্যাব থাকলেও সেখানে রয়েছে অচল ও নষ্ট কম্পিউটার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কম্পিউটার ল্যাবের জন্য আলাদা কোনো বাজেট পান না। ল্যাবের কম্পিউটারগুলো তেমন উন্নত মানের না। যেগুলো আছে তা প্রায় এক দশকেরও বেশি পুরানো।
অচল আর বাতিল কম্পিউটারের ছড়াছড়ি
সরেজমিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন বিভাগের ল্যাবে থাকা বেশিরভাগ কম্পিউটার অচল ও পুরোনো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় বিভাগে ৯৮টি কম্পিউটার অচল, জবির লাইব্রেরিতে থাকা ১০০ ল্যাপটপ ও কম্পিউটার ধীরগতির। আর একাধিক বিভাগে কোর্স থাকলেও নেই কোনো কম্পিউটার। এর মধ্যে সচল কম্পিউটারের সংখ্যা মাত্র ৮০টি।
এর মধ্যে কোর্স থাকলেও ল্যাব নেই লোকপ্রশাসন ও সমাজকর্ম বিভাগে আর অর্থনীতি বিভাগে ল্যাব থাকলেও নেই কম্পিউটার। এছাড়া অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগে অচল কম্পিউটার ৪০টি, গণিত বিভাগে ৬০টির মধ্যে ২০টি অচল, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১২টি কম্পিউটারের ৪টি অচল। মাকেটিং বিভাগে ৯টি, ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ৯টি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ৮টি কম্পিউটার অচল। এছাড়া কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সংলগ্ন কম্পিউটার ল্যাবের ১০০ ল্যাপটপ খুবই ধীরগতির।
অর্থনীতি বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, কোনো কম্পিউটার না থাকলেও নামেমাত্র কম্পিউটার ল্যাব আছে। কিন্তু ল্যাবের অবস্থাও সংকটপূর্ণ। বাজেট সংকটের কারণে কম্পিউটার ল্যাবের এ অবস্থা। তবে শিক্ষা উপকরণ হিসেবে বিভাগে যে বাজেট হয় তা থেকে কয়েকটা কম্পিউটার কেনা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো বিভিন্ন প্রয়োজনে বের করে বিভাগের শিক্ষকদের কাজ করতে হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ল্যাবে ১২টি কম্পিউটার ছিল। তবে ল্যাব থেকে ধীরে ধীরে কম্পিউটারের বিভিন্ন সরঞ্জাম হারিয়ে গেছে। এখন মাত্র চারটি কম্পিউটার অবশিষ্ট রয়েছে। তবে সেগুলোও অচল। সরিয়ে ফেলা হয়েছে কম্পিউটারগুলো। বিভাগের অন্য একটি কক্ষে পার্টিশন দিয়ে রাখা হয়েছে। মিডিয়া ল্যাব নামে কক্ষ থাকলেও তা এখন ক্লাসরুম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেমিনার কক্ষে মাত্র তিনটি কম্পিউটার সচল।
অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের ল্যাবে ৪১টি কম্পিউটার রয়েছে। কিন্তু এসব কম্পিউটারের মধ্যে মাত্র একটি কম্পিউটার সচল। বাকিগুলো অচল হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১২-১৩ সালের দিকে উচ্চ শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি প্রকল্প (হেকেপ) থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য এ ল্যাব দেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় অব্যবহৃত থেকে অচল হয়ে পড়েছে ল্যাবের কম্পিউটারগুলো। ফলে অকার্যকর হয়ে গেছে ল্যাবটি।
ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ এবং মার্কেটিং বিভাগের ল্যাবের কম্পিউটারগুলোরও একই অবস্থা। ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ২০টি কম্পিউটার রয়েছে, এর মধ্যে ৯টি অচল। ৭টি পুরোপুরি নষ্ট ও দুটি আংশিক। মার্কেটিং বিভাগের কম্পিউটার ল্যাবে একটি ল্যাপটপসহ ১৭টি ডেক্সটপ কম্পিউটার রয়েছে। এর মধ্যে সচল ৭টি। সিপিইউ না থাকায় অকেজো বাকি ৯টি কম্পিউটার। এছাড়া ১১টি কম্পিউটার শিক্ষকদের জন্য স্থানান্তর করা হয়েছে।
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের একটি কম্পিউটার কোর্স রয়েছে। তবে কম্পিউটার ল্যাব থাকলেও সেটা আর ব্যবহৃত হয় না। তালাবন্ধ রয়েছে ১২টি কম্পিউটার সম্বলিত ল্যাবটি। এর মধ্যে ৪টি সচল হলেও বাকি ৮টি অব্যবহৃত হওয়ায় অকেজো হয়ে গেছে।
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা জানান, গত কয়েক বছরে কম্পিউটার ল্যাবের তালা খুলতে দেখিনি। ল্যাবের তালায় মরিচা ধরেছে। আমাদের কম্পিউটার বিষয়ক একটি কোর্স আছে। কিন্তু কম্পিউটার ল্যাবে কোনো কাজ করা হয় না।
কম্পিউটার আবশ্যক এমন একটি বিভাগ গণিত। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভাগের ল্যাবে থাকা ৬০টি কম্পিউটারের মধ্যে ২০টি অকেজো। যান্ত্রিক ত্রুটি থাকায় সেগুলো ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে ধীরগতির ল্যাপটপ-কম্পিউটার দিয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সংলগ্ন কম্পিউটার ল্যাব। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত ব্যবহারের জন্য রয়েছে ১০০টি ল্যাপটপ। যার প্রত্যেকটির ক্রয়মূল্য ছিল ১৮ হাজার টাকা। জানা যায়, ২০১৭ সালে সরকারি একটি প্রকল্প থেকে এগুলো দেওয়া হয়। তবে দীর্ঘ দিন ধরে আপডেট না দেওয়ায় ল্যাপটপগুলোর অবস্থাও বেশি ভালো না।
জানতে চাইলে লাইব্রেরিয়ান মো. এনামুল হক বলেন, তখন এই ল্যাপটপগুলো সরকারি প্রকল্প থেকে স্বল্প মূল্যে কেনা হয়েছিল। ইলেকট্রনিক ডিভাইস কিছুদিন ব্যবহার করলে এমনিতেই ধীর গতির হয়ে যায়। সেখানে এগুলো অনেক আগের। ফলে ধীর গতিতে কাজ করবে এটা স্বাভাবিক। তবে একেবারে নষ্ট না হলেও ব্যাটারির কার্যক্ষমতা কমে গেছে। ল্যাবের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো বাজেট দেওয়া হয় না।
কম্পিউটার সংকটে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি
একাধিক বিভাগে কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট কোর্স থাকলেও অনুশীলনের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নেই। যেসব শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার নেই তাদের পড়তে হয় ভোগান্তিতে। অনুশীলনের জন্য যেতে হয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সংলগ্ন কম্পিউটার ল্যাবে। সেখানে থাকা ল্যাপটপগুলোর অবস্থাও সংকটাপন্ন। ধীর গতির হওয়া বড় সাইজের সফটওয়্যারের কাজ করতে অনেক বেশি সময় লাগে। অনেক বিভাগের ল্যাবে শুধু মনিটর আছে, সিপিইউসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি নেই। আবার উল্টো চিত্রও দেখা যায়, সবই আছে কিন্তু মনিটর নেই।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের হাসান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘শিক্ষা গ্রহণে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের কমতি রয়েছে। বিশেষ করে মিডিয়া ল্যাব। সেখানে নেই পর্যাপ্ত কম্পিউটার। প্রথম বর্ষে ‘কম্পিউটার স্কিলস’ এবং তৃতীয় বর্ষে ‘পেজ মেকআপ’সহ কয়েকটি কোর্স কম্পিউটার সম্পর্কিত। কোর্সগুলোর জন্য কম্পিউটার আবশ্যক। কিন্তু বিভাগে সেই সুযোগ নেই।’
অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী মো. ইসা হাওলাদার বলেন, ‘বিভাগে প্রায় ৯০০ শিক্ষার্থীর বিপরীতের ল্যাবটি এখন অকার্যকর। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ল্যাবটি সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশনসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট নানা কাজে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এই সময়ে এসব অব্যবস্থাপনা খুবই হতাশাজনক।’
বাজেট নেই
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাজেট স্বল্পতার কারণে কেন্দ্রীয়ভাবে আলাদা করে কম্পিউটার ল্যাবের জন্য বাজেট দেওয়া হয় না। তবে দাপ্তরিক কাজের জন্য কম্পিউটার দেওয়া হয়। বিভাগের চাহিদা ও আবেদন অনুযায়ী, এসব কম্পিউটার দেওয়া হয়। তবে বিভাগগুলো স্পন্সরের মাধ্যমে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করে। তাই ল্যাবের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট বিভাগের।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘বিভাগের কোর্স সংশ্লিষ্ট অনেক কিছুই আমাদের দরকার। ভিডিও ধারণের জন্য ক্যামেরা থেকে শুরু করে এডিটিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। একটি পূর্ণাঙ্গ কম্পিউটার ল্যাবের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু কেন্দ্রীয় বাজেট না থাকায় তা হচ্ছে না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সাবিনা শরমীন বলেন, ‘বিভাগের দাপ্তরিক কাজে প্রয়োজনে দুয়েকটা কম্পিউটার দেওয়া হয়। কিন্তু কম্পিউটার ল্যাবের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো বাজেট দেওয়া হয় না। এ ক্ষেত্রে বিভাগগুলো আলাদা স্পন্সর অথবা নিজস্ব তহবিলের মাধ্যমে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করে। ল্যাবগুলো ডিপার্টমেন্টের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট স্বল্পতার এই খাতে অর্থ সহায়তার সুযোগ নেই।’
জেএন/ওএফ/এমএইচএস