শ্রমিকের অধিকার ও উন্নয়নের প্রত্যয়

ক্যাম্পাস প্রতিনিধি, ডিআইইউ
প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ২৩:১২
-68125a0dec351.jpg)
১৮৮৬ সালের শিকাগো আন্দোলনের মাধ্যমে যে আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি গৃহীত হয়েছিল, মে দিবস তারই রক্তঝরা প্রতীক। অথচ আজও বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে শ্রমিক, বিশেষত নারী ও প্রান্তিক শ্রমিকরা বঞ্চনার শিকার। পোশাকশিল্পে হাজারো নারী শ্রমিক অবহেলা ও নিরাপত্তাহীনতায় কাজ করে যাচ্ছেন। প্রযুক্তির আগ্রাসনে শ্রমের ধরন বদলাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে নতুন চ্যালেঞ্জ। মে দিবস তাই শুধু অতীত স্মরণ নয়, বরং শ্রমিকদের মর্যাদা, অধিকার ও প্রযুক্তি-নির্ভর দক্ষতায় উত্তরণের প্রতিশ্রুতি। এবার হোক প্রকৃত অঙ্গীকার—শ্রমিক যেন হয় উন্নয়নের প্রকৃত অংশীদার। বাংলাদেশের খবরে তুলে ধরেছেন-তানজিল কাজী
পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের নারী শ্রমিক
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প আজ অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এ শিল্পে শ্রমিকের প্রায় ৯০% নারী। পাঁচ লক্ষাধিক নারী সরাসরি জড়িত এবং প্রায় সোয়া কোটি মানুষ এর ওপর নির্ভরশীল। ২০-৩০ বছরের মধ্যে ৫৩.৪৬% নারী শ্রমিক, অথচ শ্রম আইন (২০০৬) অনুসারে ১৮ বছরের নিচে শ্রমিক নিয়োগ নিষিদ্ধ থাকলেও তা লঙ্ঘিত হচ্ছে। নিয়মিত বেতন, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা এবং কর্মস্থলে নিরাপত্তার অভাব নারীদের প্রধান বাধা। অবহেলা সত্ত্বেও তারা কারখানার উৎপাদন ও জাতীয় রপ্তানিতে বড় ভূমিকা রাখছেন। মে দিবস নারীদের অধিকারের জন্য লড়াইয়ের প্রেরণা জুগিয়েছে। সঠিক কর্মবিধান, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং আর্থ-সামাজিক সুযোগ প্রদান করলে নারী শ্রমিকরা জাতীয় উন্নয়নে অনন্য অবদান রাখতে পারবে। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও শ্রমআইনের কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারীদের কর্মপরিবেশ উন্নয়ন সময়ের দাবি।
সামিহা সিরাজী লাজ
শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রযুক্তির যুগে শ্রমিকদের নতুন চ্যালেঞ্জ
যান্ত্রিক সভ্যতার দুরন্ত অগ্রগতিতে শ্রমিক শ্রেণি আজ এক অনিশ্চিত সন্ধিক্ষণে। রোবটিক্স, এআই এবং অটোমেশনের ছোঁয়ায় প্রথাগত শ্রমের সংজ্ঞা প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। একসময় যাদের হাতের দক্ষতা ছিল মূলশক্তি, আজ তাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ—প্রযুক্তি ব্যবহারের অভিজ্ঞতা ও নবদক্ষতা অর্জন। অনলাইন প্লাটফর্মের বিস্তারে কাজের সুযোগ তৈরি হলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থায়ীত্বহীনতা আর ন্যায্য মজুরির সংকট প্রকট। মে দিবসের প্রেরণায় এ সময় শ্রমিকদের চাই আত্মজিজ্ঞাসা—কীভাবে পরিবর্তনকে প্রতিরোধ নয়, সহযোগিতায় রূপান্তর করা যায়। প্রযুক্তির ঢেউয়ে হারিয়ে না গিয়ে, শ্রমিকদের উচিত নিজেদের আপডেট করে নতুন যুগের দাবির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া। মানবিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের পাশাপাশি, চাই প্রযুক্তি-নির্ভর দক্ষতার বিকাশ। সময়ের স্রোতে টিকে থাকতে হলে শ্রমিককে হতে হবে চৌকস, অভিযোজিত এবং সচেতন। আজকের চ্যালেঞ্জই আগামী দিনের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে—যদি থাকে অদম্য মনোবল আর অটুট প্রত্যয়।
সুমাইয়া ইসলাম লুনা
শিক্ষার্থী,ব্যবসা প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
নীরব শ্রমিকদের মে দিবসে অধিকারের প্রতীক্ষা
ঝলমলে রাস্তার পাশে আবর্জনার স্তূপ সরিয়ে যারা আমাদের শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখেন, ইটভাটার গনগনে আঁচে যাদের হাতের চামড়া রুক্ষ হয়ে যায়, কিংবা বদ্ধ ঘরের কোণে অন্যের সংসারের খুঁটিনাটি সামলাতে যাদের দিন কাটে - এই প্রান্তিক শ্রমিকদের জীবনে মে দিবস কতটা আলো নিয়ে আসে? আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবসে যখন বিভিন্ন স্থানে অধিকার আদায়ের মুখর স্লোগান শোনা যায়, তখন এই নীরব যোদ্ধারা হয়ত নিজেদের দৈনন্দিন সংগ্রামের সঙ্গেই লড়ে যান।
আলো ঝলমলে মঞ্চে তাদের কথা হয়ত কেউ বলে না, পত্রিকার পাতায় তাদের ছবি হয়ত তেমন ছাপা হয় না। তবুও, এই প্রান্তিক শ্রমিকরাই আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখেন, আমাদের জীবনকে সহজ করে তোলেন। তাদের শ্রমের মর্যাদা কতটুকু দেওয়া হয়, তাদের অধিকার কতটা সুরক্ষিত - এই প্রশ্নগুলো যেন মে দিবসের আলোচনায় অনেকটাই আড়ালে থেকে যায়।
মে দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সকল শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। তবে আজও প্রান্তিক শ্রমিকদের জীবন সেই লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে। তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় না, স্বাস্থ্যসেবা মেলে না সহজে, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা থাকে না বললেই চলে।
এই মে দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত এই নীরব শ্রমিকদের কণ্ঠস্বরকে শোনা, তাদের অধিকারের জন্য সোচ্চার হওয়া। শুধু আনুষ্ঠানিক আলোচনা সভা নয়, প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপের, এমন নীতির যা এই প্রান্তিক মানুষদের জীবনকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে, তাদের শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবে। আমরা সেই সমাজের স্বপ্ন দেখি যেখানে কোনো শ্রমিক আর নীরব থাকবে না, যেখানে মে দিবস শুধু অধিকার আদায়ের স্লোগান নয়, বরং প্রতিটি শ্রমিকের জীবনে সত্যিকারের পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
মুজাহিদ আল রিফাত
শিক্ষার্থী, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
তরুণ প্রজন্ম ও মে দিবস
মে দিবস এক আলোকিত সংগ্রামের কাব্য, শ্রমের সুরে লেখা অমর ইতিহাস, যেন রক্ত-ঘামে আঁকা তারাভরা রাতের স্মৃতি। ১৮৮৬ সালে শিকাগোর রাজপথে শ্রমিকদের কণ্ঠে জেগে উঠেছিল ন্যায়ের আহ্বান, আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে তাদের ছিল অদম্য সাহস। এই দিন তরুণ হৃদয়ে জ্বালায় এক নতুন অগ্নিশিখা, যা ইতিহাসের পাশাপাশি ভবিষ্যতের স্বপ্নও গড়ে।
তরুণ প্রজন্ম, তুমি প্রযুক্তির জাদুকর, ভবিষ্যৎ নির্মাণের কারিগর। তবে মনে রেখো, শ্রমিকের ঘামে ভেজা মাটির গন্ধ আর নিঃশব্দ কান্নার সুর। মে দিবসের তাৎপর্য বুঝে শ্রমিকের পাশে দাঁড়াও, সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তি দিয়ে ছড়িয়ে দাও শ্রমের সম্মানের বাণী।
এই দিন তোমার কলমে হোক সাম্যের মহাকাব্য, যেখানে শ্রমিক ও তরুণ একসঙ্গে আঁকে ন্যায়ের আকাশ। হারিয়ে যাও সেই সংগ্রামে, যেখানে প্রতিটি ঘামের ফোঁটা এক একটি তারার মতো জ্বলে। মে দিবস শেখায় শ্রমের মর্যাদা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের অনুপ্রেরণা।
নুসরাত জাহান অনামিকা
শিক্ষার্থী- বাংলা বিভাগ, সেন্ট্রাল ওমেন্স কলেজ,ঢাকা
শ্রমিকের অধিকার ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ
মে দিবস—শ্রমিকের ঘাম আর আত্মত্যাগের চিরন্তন স্মারক। ১৮৮৬ সালের শিকাগো আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস আজও আমাদের স্মরণ করায় ন্যায্য শ্রমঘণ্টার দাবি। উন্নত বিশ্বে শ্রমিকরা অধিকার পেলেও, অনুন্নত দেশে এখনো নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ন্যূনতম মজুরি ও মানবিক মর্যাদা অধরা। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ কিংবা সালভাদরের ফ্যাক্টরি আগুন—সবই আমাদের অগোচরে থাকা শ্রমিক বঞ্চনার নির্মম প্রমাণ।
যারা রক্ত-ঘামে সভ্যতার চাকা সচল রাখে, তাদের ভবিষ্যৎ কেন অনিশ্চিত? উন্নয়নের গল্প হবে অসম্পূর্ণ, যদি শ্রমিকের ঘরে না পৌঁছায় তার সুফল। শ্রমিক-মালিক আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।
আসুন, মে দিবসকে শুধু ফুল ও ফটোসেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় অঙ্গীকার করি। কারণ শ্রমিকের ঘামেই জ্বলবে উন্নয়নের আলোকবর্তিকা।
মাসুমা বিনতে মুজিব
শিক্ষার্থী- আরবি বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়