কোরবানির জন্য জেলা ভেদে গরুর জাতভিত্তিক খ্যাতি ও বৈচিত্র্য

বাকৃবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ১৭:০৯
-6840296ac6e0a.png)
ছবি : প্রতিনিধি
বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য। ঠিক তেমনই বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন জাতের গরু নিজেদের গুণে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। দেশীয় ও উন্নত জাতের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে এক বৈচিত্র্যময় গবাদিপশু খাত, যা দেশে দুধ, মাংস ও অর্থনীতিতে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আসন্ন ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে ক্রেতাদেরও আকৃষ্ট করে জাতের গবাদিপশু। কোরবানির হাটে জেলা ভেদে গরুর জাতভিত্তিক খ্যাতি ও বৈচিত্র্য দেশের পশুপালন খাতের শক্তি হিসেবে কাজ করে।
কোরবানির ঈদ সামনে রেখে দেশের পশুর হাটগুলোতে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে পুরোদমে। এই সময়ে গরুর জাত, আকৃতি ও উৎপত্তি এলাকার ওপর ভিত্তি করে পশু নির্বাচনে সচেতনতা বাড়ছে ক্রেতাদের মধ্যে। কোরবানির পশুর হাটে এখন শুধু বাহ্যিক আকার-আকৃতি নয়, গরুর স্বাস্থ্য, জাত ও পরিচর্যার পদ্ধতি বিবেচনা করে গরু ক্রয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন অনেক ক্রেতা। এ বিষয়ে নিজের মতামত জানিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) অ্যানিম্যাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম আজাদ।
বিশেষজ্ঞ ড. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, “গরুর জাতভেদে দেহের গঠন, গোশতের পরিমাণ এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতায় পার্থক্য রয়েছে। ক্রেতারা এখন এসব দিক বিবেচনা করে কোরবানির পশু বেছে নিচ্ছেন। ফলে জেলার বিশেষ জাতগুলোর প্রতি চাহিদাও বাড়ছে।”
এলাকাভেদে গরুর কোন কোন জাত জনপ্রিয় এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে অধ্যাপক আজাদ বলেন, “বাংলাদেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ গরু কোরবানি হয় তার ৫০ শতাংশই থাকে ২০০-২৫০ কেজি ওজনের দেশীয় জাতের (নন-ডেসক্রিপটিভ) গরুগুলো, বাকি অংশগুলো আসে বিভিন্ন রিজিওনাল সোর্স থেকে। তাদের মধ্যে সবার প্রথমে থাকবে চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি জেলাভিত্তিক জনপ্রিয় জাত রেড চিটাগাং ক্যাটল (আরসিসি)। এ জাতের গরুগুলো লাল রঙের, মাঝারি আকৃতির ও শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন হয়। এ গরুগুলো চট্টগ্রামে খুবই জনপ্রিয় এবং একইসাথে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এর উচ্চ চাহিদা রয়েছে। কোরবানিতে সাধারণত ২০০-২৫০ কেজির গরুর চাহিদা বেশি থাকে বিধায় আরসিসির এতো জনপ্রিয়তা।”
অধ্যাপক আরো বলেন, “মাংসে (লিন মিট) চর্বির পরিমাণ কম এমন একটি গরুর জাত উন্নয়ন হয়েছে মুন্সীগঞ্জ জেলায়, যা মিরকাদিম গরু নামে পরিচিত। এ গরুগুলোর ওজন সাধারণত ২০০-৩০০ কেজির মধ্যেই হয়। লিন মিট কোয়ালিটির কারণে রাজধানীর পুরান ঢাকার মানুষের কাছে এটি অত্যধিক জনপ্রিয়। ডেইরি রিজিওন পাবনা জেলায় একটি গরুর জাত উন্নয়ন হয়েছে, যা পাবনা ক্যাটল নামে সুপরিচিত। মূলত দুধের জন্য জাতটি জনপ্রিয় হলেও এই জাতের ষাঁড়গুলো কোরবানির বাজারে খুবই জনপ্রিয়। এই জাতের অধিকাংশ গরুর রং সাদা হয়। সাদা মেশানো ছাই রঙয়েরও হয় এই গরু। এছাড়া লাল, ধূসর বা মিশ্র বর্ণেরও হয় পাবনা ক্যাটল। গড় ওজন হয়ে থাকে ৪৫০-৫০০ কেজি। এ জাতের গরুগুলো যারা এক্সিকিউটিভ লেভেলে আছেন, ব্যবসায়ী এবং যাদের ইনকাম বেশি তারাই পছন্দ করে থাকেন।”
অধ্যাপক আজাদ বলেন, “বগুড়ার কাহালু, সারিয়াকান্দিতে একটি গরুর জাত উন্নয়ন করা হয়েছে, যা নর্থ বেঙ্গল গ্রে (এনবিজি) নামে সুপরিচিত। এর গায়ের রং সাদা তবে গলার অংশটি কালো হয়। এ জাতের গরুগুলোর ওজন আরসিসির মতোই হয়ে থাকে। এর ওজন এবং রঙের কারণে গরুটির চাহিদা দেশব্যাপী অনেক বেশি। তবে দেশে সংকর জাতের গরুর চাহিদাও দিন দিন বেড়েই চলেছে বলে জানিয়েছেন ওই অধ্যাপক।”
মাংসের গুণাগুণের বিবেচনায় কোন জাত ভালো তা জানতে চাইলে ওই অধ্যাপক বলেন, “যে গরুর মাংসে চর্বির পরিমাণ বেশি ওই মাংসের কোয়ালিটি সবচেয়ে ভালো। সেই হিসেবে আমার মতে মাংসের গুনাগুণ বিবেচনায় সবচেয়ে ভালো জাত হচ্ছে পাবনা ক্যাটল। তবে যারা চর্বিমুক্ত মাংস পছন্দ করেন তাদের জন্য ভালো হবে মিরকাদিম গরু।”
দামের দিক থেকে কোন গরুর জাত বেশি উপযোগী- এ প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আজাদ বলেন, “কোরবানির গরু কেনার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলও এর দাম। গ্রামীণ অঞ্চলের বাস্তবতা অনুযায়ী, অনেকেই ৭ জন মিলে একটি গরু কোরবানি দেন। সাধারণত প্রতিজন অংশীদার ১৫-১৬ হাজার টাকার মধ্যে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সেক্ষেত্রে একটি গরুর মোট দাম যে দাঁড়ায় ওই দামের মধ্যে সবচেয়ে ভালো গরুর জাত হিসেবে আরসিসি (রেড চিটাগাং ক্যাটল) এবং নর্থ বেঙ্গল গ্রে (এনবিজি) গরুকে বেছে নেওয়া যেতে পারে।”
সবশেষে অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, “গরুর জাতভেদে এই ভৌগোলিক বৈচিত্র্য বাংলাদেশের গবাদিপশু খাতে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। পরিকল্পিতভাবে এই খাতকে এগিয়ে নিতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে তা ইতিবাচক প্রভাব রাখবে বলে আমি আশাবাদী।”
বাকৃবি প্রতিনিধি/এএ