জুলাই আন্দোলনে হতাহতদের নির্ভরতার আরেক নাম হান্নান
প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৫, ১৬:৩০
-(3)-687a225554f7c.jpg)
জুলাই আন্দোলনে হতাহতদের নির্ভরতার আরেক নাম হান্নান। ছবি : বাংলাদেশের খবর
চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যখন আন্দোলনের রাজপথে রক্ত ঝরছিল, আহতদের পাশে দাঁড়াতে যখন অনেকেই পিছিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন নীরবে-নিভৃতে জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে এগিয়ে এসেছিলেন একজন-তার নাম মো. হান্নান। যিনি পেশায় একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক হলেও এই সময়টায় হয়ে উঠেছিলেন আহত মানুষের জন্য নির্ভরতার এক নাম।
চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে জন্ম হলেও মো. হান্নান দীর্ঘদিন ধরে থাকেন ঢাকার শিববাড়ি এলাকায়। বয়স ৫২ বছর। গত ২৫ বছর ধরে ঢাকায় অ্যাম্বুলেন্স চালান তিনি। পাশাপাশি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতির সদস্য।
হান্নান জানান, গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল ও অন্যান্য হাসপাতালে আহত শিক্ষার্থীদের প্রায় শতাধিকবার বিনা ভাড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। তার ভাষায়, ‘এটা কোনো দয়া নয়, এটা মানুষের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা।’
জুলাই আন্দোলনের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেটেও অনেক সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বাধা দিত আহত শিক্ষার্থীদের।
হান্নান বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে যারা আহতদের নিয়ে আসত, তাদের অনেকেই হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে ভয়ে চলে যেত। তখন আশপাশে থাকা আমরাই তাদের সেবা করেছি। কেউ মাথায় আঘাত পেয়েছে, কারও পা ভেঙেছে-আমরা হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে তাদের নিয়ে গেছি। কেউ টাকা দিতে পারেনি, আমরা বলিনি কিছু দিতে।’
তিনি বলেন, ‘আহতদের ঢাকা মেডিকেল থেকে অন্য হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হলে কিংবা ঢামেকে জায়গা না পেলে, তারা নিজেরাই ইসলামিয়া হাসপাতালে ভর্তি করাতে গিয়েছেন। অনেকেই ভাড়া দিতে পারত না, কিন্তু তাদের কৃতজ্ঞতা আর চোখের জলই আমার পুরস্কার।
এই সময়কার অভিজ্ঞতা স্মরণ করতে গিয়ে হান্নান বলেন, ‘আমরা নিজের জীবনের নিরাপত্তা না দেখে রাস্তায় নেমেছিলাম। চারপাশে আগুন, গুলি, কিছুই থামাতে পারেনি আমাদের। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের সেই দিনগুলোতে আমরা শুধু মানুষ বাঁচাতে চেয়েছিলাম।’
পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের আচরণ নিয়েও তীব্র আক্ষেপ রয়েছে তার। অ্যাম্বুলেন্সে থাকা গুলিবিদ্ধ রোগীদের নাম জেনে নেমে মারধর করত। এমনও হয়েছে, হাসপাতালে নিতে গিয়ে ফেরত যেতে হয়েছে, কারণ তারা রোগী নামাতে দেয়নি।
গত ৫ আগস্টের একটি অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে হান্নান বলেন, ‘চানখারপুল থেকে শিক্ষার্থীরা ঢামেকের দিকে আসছিল। শহীদ মিনারের দিক থেকে পুলিশ গুলি শুরু করে। আমরা হাসপাতালের সামনে ছিলাম, দেখেছি কীভাবে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। কারও জীবন, বয়স, পরিচয় কিছুই বিবেচনায় নেয়নি।’
হান্নান বলেন, ‘মানুষকে ওরা যেভাবে গুলি করে হত্যা করেছে, তা দেখে মনে হয়েছিল আমরা আর কখনো স্বাভাবিক হতে পারব না। আমি তো মরদেহ পরিবহন করতে অভ্যস্ত, কিন্তু এবারের অভিজ্ঞতা ভিন্ন ছিল। প্রতিটা লাশে যেন একেকটা স্বপ্ন মরে যাচ্ছিল।’
নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও কেন এমন কাজ করলেন-জানতে চাইলে হান্নানের জবাব ছিল, ‘ওরা আমাদেরই সন্তান। কেউ তো পাশে দাঁড়াতেই হত।’
- এমআই