ছাত্রলীগ ছাড়া ডাকসু নির্বাচনে নতুন নেতৃত্বের খোঁজে শিক্ষার্থীরা
প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৫১

আসন্ন ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে ছাত্ররাজনীতিতে নতুন এক আবহ তৈরি হয়েছে। টানা ১৫ বছর ধরে ক্যাম্পাসে একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রাখা ছাত্রলীগ এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। নিষিদ্ধ সংগঠনের তালিকাভুক্ত হওয়ায় তাদের কোনো প্রার্থী সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, এবার হয়তো প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
তবে শিক্ষার্থীদের অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ছাত্রলীগ না থাকলেও তাদের ছায়াপ্রার্থী বা দলীয় নিয়ন্ত্রণের কৌশল এবারও সক্রিয় থাকতে পারে। তা সত্ত্বেও অনেকেই বলছেন, দীর্ঘদিন পর দলীয় রাজনীতির বাইরে প্রকৃত ছাত্র নেতৃত্ব গড়ে ওঠার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে।
নির্বাচনের এক মাসের কিছু বেশি সময় থাকলেও ইতোমধ্যে ক্যাম্পাসজুড়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে— এবারের ডাকসু কী আসলেই ছাত্রদের প্রতিনিধি নির্বাচন হবে, নাকি শুধু আরেকটি ‘পদ বিতরণ উৎসব’ ঘটবে?
সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে ডাকসু মানে হয়ে উঠেছে দলীয় কোটা, পদ বণ্টন আর পোস্টারবাজি। কিন্তু একজন প্রকৃত নেতা হওয়ার কথা ছিল তার বন্ধুর মতো, সহপাঠীর মতো।
রোকেয়া হলের শিক্ষার্থী আফরিন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘ভিপি-জিএস মানেই যেন হয়ে গেছে ফেসবুক পোস্ট আর কিছু বক্তৃতা। অথচ হলে পানি নেই, লাইব্রেরিতে জায়গা নেই— এসব নিয়ে কেউ কথা বলে না। আমরা এমন কাউকে চাই, যে পদ নয়, দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবে।’
ক্যাম্পাস ঘুরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ মনে করেন, এবারের ডাকসু নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে প্রকৃত ছাত্র নেতৃত্ব উঠে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে শঙ্কাও রয়ে গেছে, ছাত্ররাজনীতি আবার যেন পূর্বের মতো ক্ষমতাবানদের হাতে চলে না যায়।
আইবিএ বিভাগের শিক্ষার্থী নাফিসা তাসনিম বলেন, ‘নেতৃত্ব মানে সিট বা কোটা বাণিজ্য নয়, নেতৃত্ব মানে হচ্ছে ছাত্রদের কণ্ঠ হওয়া। এবারের ভোটে সেই সত্যিকারের নেতাকে খুঁজে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।’
গত ১৫ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি মানেই ছিল ছাত্রলীগের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনে নিষিদ্ধ সংগঠনের তালিকাভুক্ত হয়েছে ছাত্রলীগ। ফলে এবারের ডাকসু নির্বাচনে সরাসরি অংশ নেয়ার কোনো সুযোগ নেই সংগঠনটির। যদিও ‘ছদ্মপরিচয়ে’ বা ‘ছায়া প্রার্থী’ হিসেবে তাদের প্রতিনিধি থাকতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন কোনো কোনো শিক্ষার্থী।
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থী রাফি বলেন, ‘ছাত্রলীগ নেই মানেই ক্যাম্পাস পুরোপুরি মুক্ত— এটা ভাবার সুযোগ নেই। অনেকে আছে, যারা দলীয় পরিচয় গোপন করে প্রার্থী হতে চাইছে। তাদের চিনে নেওয়াটাও এখন ভোটারদের দায়িত্ব।’
তবে এসব শঙ্কা ও আলোচনা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ মনে করেন, এবারের ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন ও কার্যকর নেতৃত্ব উঠে আসতে পারে। তাদের প্রধান দাবি, একটি সুষ্ঠু, স্বাধীন ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচন।
মহসিন হলের শিক্ষার্থী কাজী এহসান বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তিনটি প্রত্যাশা রয়েছে— ছাত্রলীগের ছায়া বা গডফাদার মুক্ত নির্বাচন, প্রকৃত ছাত্র নেতৃত্বের উত্থান এবং পদ নয়, বাস্তব কাজের ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভোট যদি আগের মতোই হয়, যেখানে আগেই ফলাফল লিখে রাখা হয়, তাহলে সাধারণ ছাত্রদের উৎসাহ হারিয়ে যাবে।’
বিশ্লেষকরাও বলছেন, এবারের ডাকসু নির্বাচন হতে পারে ছাত্ররাজনীতিতে একটি মোড় ঘোরানো সময়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রুবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘দীর্ঘদিনের দখলদার রাজনীতির অবসান হোক ডাকসুর মধ্য দিয়ে। এবার নেতৃত্বের আসল পরীক্ষা— ছাত্রলীগ ছাড়া ছাত্ররাজনীতি কতটা প্রামাণ্য হতে পারে।’
তিনি বলেন, যদি প্রশাসন রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে, তাহলে এটাই হতে পারে পরবর্তী প্রজন্মের গণতন্ত্র চর্চার সূচনা।
লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা লাসনা কবীর বলেন, ‘ছাত্রলীগের অনুপস্থিতি যেমন নির্বাচনী পরিবেশকে মুক্ত করছে, তেমনি নতুন চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে। দেখতে হবে, নির্বাচনের নিয়ন্ত্রণ আবার যেন অন্য কোনো চক্রের হাতে না চলে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ যদি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে, তবে এই নির্বাচন হতে পারে একটি গঠনমূলক দৃষ্টান্ত। অন্যথায়, এটি হয়ে দাঁড়াবে আরেকটি ব্যর্থ আয়োজন।’
নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আলোচনা, উৎসাহ এবং প্রত্যাশা। এবার হয়তো ডাকসু হবে সত্যিকার ছাত্র প্রতিনিধিত্বের একটি নতুন সূচনা।
এনএমএম/এমএইচএস