Logo

ক্যাম্পাস

বাবার চোখে বিসিএস দেখেছিলাম, নিজের চোখে এল সফলতা

Icon

এম ফাহিম, চরফ্যাসন (ভোলা)

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৪৮

বাবার চোখে বিসিএস দেখেছিলাম, নিজের চোখে এল সফলতা

বিমান সরকার। ছবি : সংগৃহীত

হাওরের পানি আর ঢেউয়ের মতোই ছিল তাঁর শৈশব—অবাধ, দুরন্তপনা আর অগোছালো। নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম শ্যামপুরে জন্ম নেওয়া সেই চঞ্চল ছেলেটির নাম বিমান সরকার।

তাঁর বেড়ে উঠার গল্প যদিও সিনেমার মতো নয়, তবে বাস্তবের মতোই কঠিন আর প্রেরণায় ভরা। বর্তমানে তিনি চরফ্যাসন সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক। ৪৩তম বিসিএস-এ প্রথম চেষ্টাতেই শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন।

বিমানের শৈশবের অধিকাংশ সময় কাটত খেলাধুলা, মাছ ধরা আর গ্রামের মাঠে-নদীতে ছুটে বেড়ানোর মধ্যেই। পড়াশোনায় মন বসত না তার। তাই বাবা-মা মিলে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন—বিমানকে পাঠানো হয় মামাবাড়ি। সেখানে দাদা-দিদির শাসন আর ভালোবাসায় বদলাতে শুরু করে জীবনের গতি।

পড়াশোনায় মনোযোগ আসে ধীরে ধীরে। ২০১২ সালে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। এরপর সিলেট সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে এইচএসসিতে ৪.৯০ জিপিএ পান। তখন থেকেই টিউশনি শুরু। যাতে নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালাতে পারেন। তিনি বলেন ‘সংসারের অবস্থা ভালো ছিল না। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম নিজের চেষ্টায় নিজের জীবন গড়তে।’

বিমান সরকার ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পেয়েছিলেন একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে নিয়ে যায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্লাসের শুরু থেকেই বিসিএসের কথা মাথায় রাখেন। কোচিং না করে নিজেই তৈরি করতে থাকেন নিজেকে—লাইব্রেরিতে পড়া, মডেল টেস্ট, পত্রিকা, সাহিত্য, সংবিধান, ইতিহাস—সব কিছুতেই আগ্রহ। বিমানের  আত্মনির্ভর প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই।

বিমান বলেন, ‘বাবা ছিলেন শিক্ষক। তাঁর মুখেই প্রথম শুনি বিসিএস শব্দটি। তিনি বলতেন—শিক্ষকতা শুধু চাকরি নয়, এটা দায়িত্ব।’

২০১৮ সালে বাবার মৃত্যু তাঁকে গভীর শোকের সাগরে ডুবিয়ে দিলেও সেই শোককেই তিনি রূপ দেন শক্তিতে। তিনি বলেন ‘আজ আমি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, তা বাবার দেখানো পথ ধরেই।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেই চাকরির ফাঁকে বিসিএসের প্রস্তুতি চালিয়ে যান। ৪৩তম বিসিএস ছিল তাঁর প্রথম পরীক্ষা। সেখানেই তিনি সুপারিশপ্রাপ্ত হন শিক্ষা ক্যাডারে। তিনি বলেন ‘ভাইভার দিন আমি খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছিলাম। বোর্ড বুঝতে পেরেছিল, আমি এই পেশাকে ভালোবাসি’।

কয়েকটি ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষায়ও লিখিত অংশে উত্তীর্ণ হন, কিন্তু ভাইভায় যাননি। কারণ তাঁর চোখে ছিল শুধু একটিই লক্ষ্য—শিক্ষকতা।

বিমান সরকার বলেন, ‘বিসিএস শর্টকার্টে হয় না। এটা সময়সাপেক্ষ প্রস্তুতির ফল। নিয়মিত পড়ার অভ্যাস, সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ, পত্রিকা পড়া, বিষয়ভিত্তিক গভীরতা—এসব দরকার।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘সফল হতে হলে পড়াকে উপভোগ করতে হবে। আত্মবিশ্বাস আর ধৈর্য থাকলে পথ অনেক সহজ হয়।’

শিক্ষকতা দিয়েই পেশাগত জীবন শুরু করেছেন বিমান। তবে এখানেই থেমে যেতে চান না। তাঁর স্বপ্ন, এমন একজন শিক্ষক হওয়া—যিনি শুধু পাঠ্যপুস্তক শেখান না, বরং ছাত্রদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন।

ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছা রয়েছে তাঁর। আর যদি সুযোগ আসে, তবে পররাষ্ট্র ক্যাডারে গিয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতেও আগ্রহী।

বিমান সরকার সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘জীবনে প্রথম বিসিএস দিয়েই সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। এটা আমার না, আমার বাবা-মায়ের, ভাইয়ের, শিক্ষকদের এবং গ্রামের সেই ছেলেটির জয়—যে একদিন হাওরের মাঠে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বলেছিল, আমি একদিন কিছু হবো।’

এআরএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর