ডাকসু নির্বাচনের আগে ঢাবিতে ‘হল রাজনীতি’ নিয়ে বিতর্ক

ডিজিটাল ডেস্ক
প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৫, ২০:২৫

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্য। ছবি : সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ‘প্রকাশ্য ও গুপ্ত’ রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে— এমন ঘোষণা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নানা আলোচনা ও বিতর্ক চলছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পর এই সিদ্ধান্তটি নতুনভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমেদ স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, আবাসিক হলে ‘প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি’ উভয়ই নিষিদ্ধ থাকবে। তবে উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান শুক্রবার রাতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলাপের সময় বলেন, ‘হল পর্যায়ে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত থাকবে।’ এই অবস্থান নিয়েই ক্যাম্পাসে বিরোধ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে।
কেন এ সিদ্ধান্ত?
২০২৪ সালের ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্টরা আবাসিক হলে ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে ওই সিদ্ধান্ত তখন সিন্ডিকেট অনুমোদন পায়নি। জানা গেছে, গতবছর আন্দোলনের মুখে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হল ছাড়ার পর প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের চাপ দিয়ে ‘হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ’ লেখা সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ওই সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাবির অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে হলে রাজনীতি নিষিদ্ধের একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই, এটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হতে হবে, যা হয়নি।’
চলমান প্রেক্ষাপট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের তারিখ আগামী ৯ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এখন নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। তবে আবাসিক হলে সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত থাকায় নির্বাচনী প্রক্রিয়া পরিচালনায় নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে।
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, ‘নির্বাচনের আগে ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রণের নামে কিছু সংগঠন সুবিধা নিতে চাইছে। যারা প্রকাশ্যে কমিটি গঠন করে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব হলেও যারা গোপনে রাজনীতি করে, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।’
অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, যিনি ডাকসু আচরণবিধি প্রণয়ন ও সংশোধন কমিটির সদস্য ছিলেন, মনে করেন ডাকসু নির্বাচনের আগে বিভিন্ন ইস্যু এনে পরিস্থিতি উত্তেজনাকর হয়েছে। তিনি বলেন, ‘কিছু সংগঠনের পক্ষপাতমূলক সুবিধা প্রদানের জন্য হলে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সামনে এসেছে। ডাকসুর পর জাতীয় নির্বাচনও আছে, যার ওপর এই পরিস্থিতির প্রভাব পড়বে।’
বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ
গত শুক্রবার ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ১৮টি আবাসিক হলের কমিটি ঘোষণা করলে রাতে বিভিন্ন হলে তীব্র বিক্ষোভ শুরু হয়। রোকেয়া ও শামসুন নাহার হল থেকে ছাত্রীরা বের হয়ে বিক্ষোভে যোগ দেন। পরে রাজু ভাস্কর্য এলাকায় সমাবেশ করে তারা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন।
শিক্ষার্থীরা ‘হল রাজনীতি নিষিদ্ধের’ দাবি জানিয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের পাশাপাশি প্রক্টর ও উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলেন। তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহিংসতার আশঙ্কাও দেখা দেয়। উপাচার্য নিজেও বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৭ জুলাই প্রভোস্টদের সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে।’ কিন্তু বিক্ষোভকারীরা ‘না, না’ বলে পাল্টা প্রতিবাদ করেন।
ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ ও বিভিন্ন সংগঠনের মত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেঘমল্লার বসু বলছেন, ‘হল রাজনীতি বন্ধের ঘোষণাটি অপরিণামদর্শী ও চটকদার’। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে রাজনীতি না করলে আমরা সচিবালয়ে গিয়ে রাজনীতি করবো কি?’
অন্যদিকে ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন দাবি করেন, গত বিক্ষোভ ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার আন্দোলন। তিনি বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনের আগে ছাত্রদলের প্রতি ঈর্ষান্বিত কিছু রাজনৈতিক দল বাগাড়ম্বর করে এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে।’
ইসলামী ছাত্র শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন খান ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ ব্যানারে আন্দোলনের পেছনে শিবিরের কোনো ইন্ধন থাকার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হল রাজনীতি বন্ধ থাকায় আমরা কমিটি দিইনি। শিক্ষার্থীরা যেভাবে চাইবে, সেভাবেই চলবো।’
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক আব্দুল কাদের আরো বলেন, ‘কেউ মব তৈরি করে বলছে, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকবে না, আবার কেউ বলছে হলে থাকবে না। এই সুযোগ যারা পরিচয় লুকিয়ে রাজনীতি করে, তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।’
প্রশাসনের অবস্থান ও চ্যালেঞ্জ
উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান শুক্রবার শিক্ষার্থীদের বলেছেন, ‘ডাকসুর প্যানেল গঠন ও কার্যক্রমে হলে কাজ করতে হবে। এজন্য সকলের মধ্যে ঐক্যমত্য দরকার।’ তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সবার সঙ্গে আলোচনায় বসে সিদ্ধান্ত নেবে।
তবে প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদের ঘোষণা যে, আবাসিক হলে প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি দুটোই নিষিদ্ধ থাকবে, তা নিয়ে ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সংশয় ও প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বিশেষ করে গুপ্ত রাজনীতি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, সেটি স্পষ্ট নয়।
অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীর’ পরিচয় অনেক সময় রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই ব্যবহার হয়। এই কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নাম দিয়ে রাজনীতি বন্ধের দাবি অন্য কোনো বিষয় লুকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা বলে মনে করেন অনেকেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলে ‘প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি নিষিদ্ধের’ বিষয়টি বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে। আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি ও এই ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সমঝোতা গড়ে উঠা সময়সাপেক্ষ হলেও অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
সূত্র : বিবিসি নিউজ বাংলা, ৯ আগস্ট ২০২৫
এমএইচএস