১৯ বছরে কুবিতে চাকরি ছেড়েছেন ১৪ শিক্ষক, পাওনা টাকা আড়াই কোটির বেশি
ইমতিয়াজ রিফাত, কুবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২০:০৭
২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) থেকে মোট ১৪ জন শিক্ষক চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। এর মধ্যে ৬ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওনা টাকা পরিশোধ করেছেন। তবে ৮ জনের মধ্যে কারও কাছে এখনো আংশিক এবং কারও কাছে পুরো টাকা বাকি রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে দেশে আর ফেরেননি অথবা ফেরার পরও চুক্তি অনুযায়ী পূর্ণ সময়ের মধ্যে অধ্যাপনা শেষ করেননি ওই ৮ শিক্ষক। হিসাব অনুযায়ী, তাদের কাছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওনা রয়েছে ২ কোটি ৬৭ লাখ ৪৪ হাজার ৮৬৬ টাকা।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ছুটি নীতিমালার ধারা ৩, ৩.১, ৩.৩ ও ৪-এ বলা হয়েছে, মাস্টার্স বা সমমানের ডিগ্রির জন্য শিক্ষক সর্বোচ্চ ২ বছর পূর্ণ বেতনে শিক্ষা ছুটি পাবেন। মাস্টার্স থেকে পিএইচডিতে রূপান্তরিত হলে সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত ছুটি পাওয়া যাবে এবং প্রয়োজন হলে অতিরিক্ত আরও ১ বছর বাড়ানো যেতে পারে। সরাসরি পিএইচডির জন্য সর্বোচ্চ ৪ বছর পূর্ণ বেতনে ছুটি মঞ্জুর হবে, প্রয়োজনে আরও ১ বছর বাড়ানো যাবে। আর পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণার জন্য সর্বোচ্চ ২ বছর পূর্ণ বেতনে শিক্ষা ছুটি দেওয়া হবে।
ধারা ৯.১ অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক পূর্ণ বেতনে শিক্ষা ছুটি পেলে তিনি যতদিন শিক্ষা ছুটি নেবেন, ফিরে এসে ততদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে বাধ্য থাকবেন। যদি তিনি চাকরি না করেন বা মাঝপথে ছেড়ে দেন, তবে শিক্ষা ছুটির সময় প্রাপ্ত সমস্ত বেতন-ভাতা ব্যাংকের সুদসহ ফেরত দিতে হবে। তবে আংশিক সময় চাকরি করলে সেই অংশ বাদ দিয়ে বাকি অর্থ ফেরত দিতে হবে। শিক্ষক নিজে টাকা ফেরত না দিলে তার গ্যারান্টারকে সেই টাকা পরিশোধ করতে হবে। আর কত কিস্তিতে বা কীভাবে টাকা ফেরত দেওয়া হবে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট নির্ধারণ করবে।
নীতিমালা অনুযায়ী সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক পাওনা পরিশোধ না করা শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তাসনিমা আকতার। তিনি ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে শিক্ষা ছুটি নিয়ে বিদেশে গেলেও আর ফিরে যোগদান করেননি। তার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওনা ছিল ২৮ লাখ ৮৬ হাজার ৮৪০ টাকা। এর মধ্যে তিনি ২৫ লাখ ৬১ হাজার ৯৭২ টাকা পরিশোধ করলেও এখনও বাকি রয়েছে ৩ লাখ ২৪ হাজার ৮৬৮ টাকা।
একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাদিয়া সরোয়ার ২০১৭ সালে মাস্টার্স এবং ২০১৯ সালে পিএইচডির জন্য শিক্ষা ছুটি নেন। তবে ২০২৪ সালে ছুটি শেষ হলেও তিনি যোগদান না করায় তার কাছে ৪৬ লাখ ২৯ হাজার ৫৮৬ টাকা পাওনা রয়েছে। আরেক সহযোগী অধ্যাপক জাহিদুল আলম ২০১৮ সালে পিএইচডির জন্য বিদেশে যান এবং ২০২৪ সালে ছুটি শেষ হলেও ফিরে আসেননি। তার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওনা ৪৭ লাখ ৪৭ হাজার ৭৪৫ টাকা।
ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইসিটি) বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অরভিলা সরকার ২০১৯ সালে পিএইচডির জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। এরপর তিনি চলতি বছরের মার্চ মাসে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন। তার কাছে পাওনা ৩৪ লাখ ৯২ হাজার ৩৮৫ টাকা।
পরিসংখ্যান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দীপা রানী ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য শিক্ষা ছুটি নেন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে শিক্ষা ছুটি শেষ হলেও তিনি যোগদান করেননি। তার কাছে পাওনা রয়েছে ১৯ লাখ ১২ হাজার ৭২৬ টাকা।
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাহফুজুর রহমান ২০১৭ সালে পিএইচডি এবং ২০২৩ সালে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণার জন্য শিক্ষা ছুটি নেন। চলতি বছরের জুলাইয়ে তার যোগদানের সময়সীমা শেষ হলেও তিনি ফিরে আসেননি। ফলে তার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৬২ লাখ ৫৬ হাজার ৬২৭ টাকা।
একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. জাকির হোসাইন ২০১৭ সালে শিক্ষা ছুটি নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন। কিন্তু আর ফেরেননি। তার কাছে সর্বমোট পাওনা ছিল ৪০ লাখ ৬৯ হাজার ৭২৬ টাকা। তবে তিনি ৩ লাখ টাকা পরিশোধ করায় বর্তমানে বাকি রয়েছে ৩৭ লাখ ৬৯ হাজার ৭২৬ টাকা।
অন্যদিকে, লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান ২০১৫ সালে শিক্ষা ছুটি নিয়ে বিদেশে যান। ২০১৯ সালে ফিরে এসে পুনরায় যোগদান করলেও ২০২৩ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে অব্যাহতি নিতে পদত্যাগপত্র জমা দেন। তার কাছে বর্তমানে সর্বমোট ১৬ লাখ ১১ হাজার ২০৩ টাকা পাওনা রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাদিয়া সরোয়ার বলেন, ‘আমার পিএইচডি প্রোগ্রাম এখনো চলমান থাকায় আমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে এক বছরের বিশেষ ছুটি (৩১ আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত) চেয়েছিলাম। এ আবেদন আমার সুপারভাইজারের সুপারিশপত্র দ্বারা সমর্থিত ছিল, কারণ কোভিড-১৯ মহামারির কারণে আমার গবেষণা ও পড়াশোনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমার আবেদনে সাড়া না দিয়ে উল্টো আমাকে নিয়ে মিথ্যা অভিযোগ তোলে যে আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। এটি ছিল অন্যায় ও অপমানজনক, যা আমার সম্মানহানি করেছে। ফলে আমি বাধ্য হয়ে চাকরি থেকে পদত্যাগ করি। অথচ সম্প্রতি একই পরিস্থিতিতে আরেকজন শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশেষ ছুটি অনুমোদন করেছে, যা আমার ক্ষেত্রে বৈষম্য নির্দেশ করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের চিঠির জবাবে পাওনা টাকা ফেরতের বিষয়ে লিখিতভাবে উত্তর দিয়েছি। কিন্তু বহুবার যোগাযোগের পরও তারা কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাবের তথ্য বা ফেরতের পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়নি। এতে ফেরত প্রদানের প্রক্রিয়া অপ্রয়োজনীয়ভাবে জটিল হয়ে উঠেছে। আমি প্রশাসনের কাছে সঠিক হিসাবের তথ্য চেয়েছি, যাতে দ্রুত ফেরত প্রক্রিয়া শুরু করতে পারি। পাশাপাশি, আমি আমার প্রভিডেন্ট ফান্ড, অর্জিত ছুটি ও অন্যান্য পাওনা অর্থের তথ্য চেয়েছি। তবে এখনো কোনো উত্তর পাইনি।’
লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান বলেন, ‘আমি ২০১৯ সালে বিদেশে উচ্চশিক্ষা শেষ করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি এবং প্রায় চার বছর সেখানে শিক্ষকতা করি। ২০২৩ সালের মে মাসে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেই। বর্তমানে আমার পদত্যাগ ও সংশ্লিষ্ট আর্থিক বিষয়গুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছে, যা আমি পর্যালোচনা করছি। প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই সমাধান হবে।’
আইসিটি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অরভিলা সরকার বলেন, ‘আমি ইতোমধ্যে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি চিঠি পাঠিয়েছি যাতে তারা আমাকে জনতা ব্যাংক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সহায়তা করে। সেই চিঠিতেই আমি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছি কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছি। আমি সম্পূর্ণভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য। বর্তমানে আমি জনতা ব্যাংকের উত্তরের অপেক্ষায় আছি, কারণ আমি অধ্যয়ন ছুটিতে থাকাকালীন আমার বেতনের টাকা অ্যাকাউন্ট থেকে উত্তোলন করিনি। তাই ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়াটি খুব সহজ—আমার বেতনের টাকা জনতা ব্যাংক থেকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করলেই হবে। তবে জনতা ব্যাংক থেকে উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমি এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারছি না। আশা করি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে ব্যাংক ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগে সহায়তা করবে। আর বাকি যে সামান্য অর্থ রয়েছে, তা আমি অস্ট্রেলিয়া থেকে পাঠিয়ে দেব।’
অন্য পাঁচজন শিক্ষকের সঙ্গে একাধিকবার ইমেইলের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের পাওনা টাকা আদায়ের প্রক্রিয়া নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী চলমান আছে। আমরা চিঠি দিয়েছি তাদেরকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে পাওনা টাকা আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমে বিষয়টি সিন্ডিকেটকে অবহিত করা হয়, পরে সিন্ডিকেটের নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। হিসাব-নিকাশ যাচাইয়ের পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়। যদি তিনি সাড়া না দেন, তবে যে দেশে অবস্থান করছেন সেই দেশের দূতাবাসে চিঠি পাঠানো হয় এবং তখন দূতাবাস প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এবার আমি আসার পর থেকে এই এক বছরে প্রায় তিনগুণ বেশি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। টাকা আদায়ে প্রায় তিন বছর সময় লেগে যায়। এ সময়ে শিক্ষকদের পদ শূন্য থাকায় শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এসব পদে অন্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয়।’
এমএইচএস


