Logo

ক্যাম্পাস

আবরার হত্যার ৬ বছর : যেভাবে ঘটেছিল নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড

Icon

বাংলাদেশের প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৩৬

আবরার হত্যার ৬ বছর : যেভাবে ঘটেছিল নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যার ছয় বছর আজ মঙ্গলবার। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীর হাতে নিহত হন দ্বিতীয় বর্ষের এ শিক্ষার্থী। ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি মামলার বিচারকাজ।

আবরারের মা রোকেয়া খাতুন আজও ভুলতে পারেননি সেই রাতের কথা। ছেলের ব্যবহৃত হাতঘড়ি, ব্যাগ, বই, পরিচয়পত্র—সবকিছুই যত্নে রেখে দিয়েছেন তিনি। কিছু পুরোনো চকলেট দেখিয়ে বলেন, ‘আবরার ঘুমানোর আগে মুখে চকলেট দিয়ে ঘুমাত। সেগুলোও রেখে দিয়েছি ছয় বছর ধরে।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে যোগ করেন, ‘ছেলের ঘড়ির কাঁটা বন্ধ হয়ে গেছে, জানি না আর কত দিন এভাবে থেমে থাকবে।’

আবরার ছিলেন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র। থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে। ৫ অক্টোবর ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার পরদিন রাতেই তাকে হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাকে।

রাত তিনটার দিকে হলের সিঁড়ি থেকে আবরারের নিথর দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার পরদিন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ চকবাজার থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। একই বছরের ১৩ নভেম্বর ২৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় পুলিশ। ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ রায়ে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে মামলার ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। দীর্ঘ শুনানি শেষে চলতি বছরের মার্চে বিচারিক আদালতের দেওয়া দণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্টের বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের বেঞ্চ।

সেদিন যা ঘটেছিল

ছুটি কাটিয়ে কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়ি থেকে ৬ অক্টোবর বিকেলে নিজের ক্যাম্পাসে ফেরেন আবরার। ওইদিন বিকেলের দিকে শেরেবাংলা হলে নিজের ১০১১ নম্বর কক্ষে পৌঁছে ফোনে মায়ের সঙ্গে কথাও বলেন। শিক্ষার্থীরা জানান, বাড়ি থেকে ফিরে আবরার নিজের কক্ষে পড়ালেখা করছিলেন। ৬ অক্টোবর রাত ৮টার দিকে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী আবরারের কক্ষে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসেন। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ২০১১ নম্বর কক্ষে। এ কক্ষে থাকেন ছাত্রলীগের চার নেতা। সেখানে তার মোবাইল ফোন তল্লাশি করেন নেতারা। ওই কক্ষে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ।

তারা আবরারের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে সেটি যাচাই করেন। এক পর্যায়ে আবরারকে তার ফেসবুক আইডি খুলতে বলেন। পরে তারা তার ফেসবুক ও মেসেঞ্জার ঘেঁটে তাকে শিবিরের নেতা হিসেবে উল্লেখ করেন। এর পরই ওই দুই নেতার সঙ্গে থাকা আরও কয়েকজন তাকে মারধর শুরু করেন। আবরারকে ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটানো হয়। ‘শিবির ধরা হয়েছে’- এমন খবর পেয়ে সেখানে সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলের অনুসারী আরও সাত থেকে আটজন নেতা জড়ো হন। তারাও সেখানে তাকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। এক পর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে যায় আবরারের দেহ। রাত ২টার পর তাকে ওই কক্ষ থেকে বের করে হলের সিঁড়িতে ফেলে রাখা হয়।

একজন শিক্ষার্থী জানান, ২০১১ নম্বর কক্ষ থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চিৎকার ভেসে আসছিল। তবে ঝামেলা এড়াতে তিনি ওই কক্ষে যাননি। কক্ষটিতে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাসহ তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী ছিল। তারাও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। সকালে বুঝতে পারেন, সেখানে আবরারকে হত্যা করা হয়েছে।

অপর দু’জন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, পেটাতে পেটাতে আবরারকে হল ছাড়ার নির্দেশ দেন ছাত্রলীগের নেতারা। তিনি তাতে রাজিও হন। এরপরও তাকে ছাড়া হয়নি; নৃশংস ও নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। হলের নিরাপত্তাকর্মী মোহাম্মদ মোস্তফা সে সময় দাবি করেন, প্রতি রাতেই শিক্ষার্থীরা নানা বিষয়ে কমবেশি হৈ-হুল্লোড় করেন। কিন্তু রোববার রাতে তিনি কোনো চিৎকার শোনেননি। বিষয়টি গভীর রাতে জানতে পারেন তিনি।

আবরারকে হত্যার ঘটনা জানাজানির পর হলজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নিহত ওই ছাত্রের রুমমেট ও সহপাঠীরাও এ বিষয়ে প্রথমে মুখ খুলতে চাননি। পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আবরারের কয়েকজন সহপাঠী জানান, হত্যার পর দীর্ঘক্ষণ আবরারের লাশটি ২০১১ নম্বর কক্ষেই পড়ে ছিল। রাত ২টার দিকে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী তার নিথর দেহ নামিয়ে আনেন। এক পর্যায়ে নিচতলা ও দোতলার মাঝখানের সিঁড়িতে তার লাশটি ফেলে রাখা হয়।

শেরেবাংলা হলে একজন আবাসিক ছাত্র সে সময় জানান, তিনি রাত ২টার দিকে পানি আনতে গিয়ে দেখেন নিচতলা ও দোতলার সিঁড়ির মাঝে তোশকের ওপর আবরারের নিথর দেহ পড়ে আছে। তখন সেখানে ছাত্রলীগের অন্তত তিনজন দাঁড়িয়ে ছিলেন। এতে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ঘটনা জানাজানি হয়। তখন সবাই হলের চিকিৎসকদের খবর দেন। চিকিৎসক এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।

অ্যাম্বুলেন্স ডাকার এক পর্যায়ে চিকিৎসক জানান, আবরার আর নেই, মারা গেছে। ততক্ষণে ছাত্রলীগের ওই কর্মীরা পালিয়ে যান। ওই সময়ে হলের প্রভোস্টও ঘটনাস্থলে আসেন। বুয়েটের চিকিৎসক মাশরুক এলাহী সে সময় জানান, খবর পেয়ে তিনি রাত ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বুঝতে পারেন- ছেলেটি বেঁচে নেই।

ঘটনার বিষয়ে পরদিন হলের প্রভোস্ট জাফর ইকবাল খান জানান, এক শিক্ষার্থী হলের সামনে পড়ে আছে খবর পেয়ে তিনি দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান। শরীরে আঘাতের চিহ্ন পেয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে খবর দেন।

হত্যার পর বুয়েটের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, আবরারকে কয়েকজন ছাত্র চ্যাংদোলা করে কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। পরে তারা হলের করিডোরে দৌড়ে ফিরে আসে। সেই ফুটেজের সূত্র ধরে পুলিশ শনাক্ত করে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের।

হাইকোর্টে রায় হলেও এখনো আপিল বিভাগে শুনানি বাকি। এ কারণে চূড়ান্ত রায় কার্যকর হয়নি। আবরারের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ‘ছয় বছর পার হলেও এখনো ন্যায়বিচার শেষ হয়নি।’

এসআইবি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

বুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর