বিজয়ের চেতনায় বাংলাদেশ : তরুণ কণ্ঠে ইতিহাস, নেতৃত্ব ও ভবিষ্যৎ
ক্যাম্পাস ডেস্ক
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬:২৭
১৬ ডিসেম্বর বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়ের দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর একটি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ জন্ম নেয়। লাখো শহীদের আত্মত্যাগ, অগণিত মায়ের অশ্রু আর মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহসের বিনিময়ে অর্জিত এই বিজয় আমাদের গর্ব ও পরিচয়। বিজয় দিবস শুধু উৎসব নয়; এটি ইতিহাস স্মরণের দিন, চেতনা জাগরণের দিন। এই দিন আমাদের শিখায় দেশপ্রেম, মানবিকতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার সাহস। লাল-সবুজ পতাকার প্রতি শ্রদ্ধায় আজ আমরা মাথা নত করি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরেছেন-তানজিল কাজী
ডিসেম্বরের ডাক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তরুণ সমাজের দায়বদ্ধতার ইতিহাস
ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাবলি কেবল স্মরণীয় ইতিহাস নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিন্তা, চেতনা ও দায়িত্ববোধ গঠনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা। এই মাস আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় সাহস, ত্যাগ ও স্বাধীনতার জন্য নিরলস সংগ্রামের মূল্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আন্দোলন প্রমাণ করে, অন্যায়, দমন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ছাত্রসমাজ সবসময়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

আজকের তরুণদের কাছে এসব ঘটনা শুধু পাঠ্যবইয়ের তথ্য নয়; বরং বাস্তব জীবনে ন্যায়, মানবিকতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার অনুপ্রেরণা। ডিসেম্বরের ইতিহাস মুক্তচিন্তা, সামাজিক দায়িত্ববোধ ও সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার পথ দেখায়। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসেম্বর কেবল অতীত নয়— এটি সুশাসন, ন্যায়বিচার ও গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বর্তমান প্রজন্মকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগায়। এই ইতিহাস থেকেই ভবিষ্যতের পথ আরও দৃঢ় হয়।
তাবাসসুম নিশু
দর্শন বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিজয়ের চেতনায় গড়ে উঠুক নৈতিক নেতৃত্ব
বিজয়ের চেতনা শুধু একটি ঐতিহাসিক স্মৃতি নয়; এটি জাতির নৈতিক দিকনির্দেশনা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছে আত্মত্যাগ, সত্যনিষ্ঠা ও ন্যায়বোধের মূল্য। এই মূল্যবোধকে ধারণ করেই আজ প্রয়োজন নৈতিক নেতৃত্বের— যে নেতৃত্ব ক্ষমতার নয়, দায়িত্বের; সুবিধার নয়, সেবার।

নৈতিক নেতৃত্ব মানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও মানবিকতা। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে সমাজের প্রতিটি স্তরে— রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা, ব্যবসা ও গণমাধ্যমে— নৈতিকতার সংকট দৃশ্যমান। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অসহিষ্ণুতা আমাদের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিজয়ের চেতনা স্মরণ করায়, নেতৃত্বের আসল শক্তি আসে জনগণের আস্থা থেকে, ভয় বা প্রভাব থেকে নয়।
এই প্রেক্ষাপটে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সত্য কথা বলা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ও জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার চর্চা করে, তবে নেতৃত্বের সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা, পরিবারে মূল্যবোধের চর্চা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে কঠোরতা— সব মিলিয়ে নৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব।
বিজয়ের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক— ক্ষমতার মোহ নয়, ন্যায় ও মানবিকতার পথে চলাই নেতৃত্বের আসল পরিচয়। তাহলেই স্বাধীনতার অর্জন হবে টেকসই, আর ভবিষ্যৎ হবে আস্থার।
মুজাহিদ আল রিফাত
শিক্ষার্থী-ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
বিজয়ের মাসে ফিরে দেখা : পরিসংখ্যানের উন্নয়ন নাকি সুশাসনের সংকট?
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আজও একটি প্রশ্ন আমাদের বিবেককে দংশন করে। আমরা কি সত্যিই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছি? অবকাঠামোগত জৌলুস বাড়লেও সুশাসন, দুর্নীতি আর জবাবদিহিতার অভাবে জীবনযাত্রার মান ও মানবিক সূচকে বাংলাদেশ আজও তার পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। ধনী-দরিদ্রের ক্রমবর্ধমান ব্যবধান আমাদের পিছিয়ে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও বিজয়ের মাধ্যমে যে জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, তার লক্ষ্য ছিল শোষণহীন সমাজ। তৎকালীন যুদ্ধবিধ্বস্ত ও ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ খ্যাত দেশটি আজ ২০২৫ সালে প্রায় ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশ। সত্তর দশকে যেখানে সাক্ষরতার হার ছিল ২০ শতাংশের নিচে, আজ তা ৭৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ফাইভ-জি ও স্টার্টআপ সংস্কৃতির যুগে প্রবেশ করেছে। গড় আয়ু ৪৭ থেকে বেড়ে ৭৩-এ উন্নীত হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে বড় অর্জন। সামাজিক কাঠামোতে যৌথ পরিবার ভেঙে এককেন্দ্রিক জীবনব্যবস্থা এলেও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অভাবনীয়ভাবে বেড়েছে।
ডিসেম্বর আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই রূপান্তর সম্ভব হয়েছে একাত্তরের সেই ইস্পাতকঠিন ঐক্যের কারণে। অথচ আজ রাজনৈতিক বিভাজন ও অসহিষ্ণুতা সেই ঐক্যকে ম্লান করে দিয়েছে।
স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেন আমরা পিছিয়ে? পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং গিনি সহগ (Gini Coefficient) বা আয় বৈষম্য বৃদ্ধি প্রমাণ করে সম্পদের সুষম বণ্টন হয়নি। মেধা পাচার (Brain Drain), দুর্বল বিচার ব্যবস্থা এবং প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতার কারণে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নাগরিক অধিকারের মতো মৌলিক সূচকে আমরা আজও কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করতে পারিনি। বিজয়ের সার্থকতা কেবল জিডিপি বৃদ্ধিতে নয় বরং মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠাতেই নিহিত।
আশিক মাহমুদ
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান : প্রশ্নটা এখনো রয়ে গেছে
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশ। এই স্বাধীনতা কোনো দান ছিল না— এটি অর্জিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত, ত্যাগ ও সাহসের বিনিময়ে। তাই স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর দাঁড়িয়ে একটি প্রশ্ন বারবার সামনে আসে— আমরা কি তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দিতে পেরেছি?

রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাতা, চিকিৎসা ও সম্মাননার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে— এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু একই সঙ্গে দেখা যায় অবহেলা, তালিকা বিতর্ক ও রাজনৈতিক বিভাজন। মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতা মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদাকেই ক্ষুণ্ন করে। অথচ মুক্তিযুদ্ধ কোনো দলের নয়— এটি পুরো জাতির অস্তিত্বের ভিত্তি।
আমাদের আগের প্রজন্ম অস্ত্র হাতে দেশ স্বাধীন করেছে। আর আজকের তরুণ প্রজন্মের দায়িত্ব সেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করা— সত্য, ইতিহাস ও ন্যায়বোধের মাধ্যমে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সম্মান মানে শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়; তাঁদের আদর্শকে জীবনে ধারণ করা।
৫৪ বছরে আমরা হয়তো অনেক কিছু করেছি, কিন্তু সবটুকু পারিনি। এখনো সময় আছে— মুক্তিযুদ্ধকে বিভাজনের নয়, ঐক্যের শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার। তবেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের সম্মান হবে সত্যিকারের।
এসএম জুবায়ের আহমেদ,
কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অফিস স্কলার্স।
টিকে/এসএসকে

