বিজয়ের চুয়ান্ন বছর : তারুণ্যের ভাবনা ও অনুপ্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধ
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০:৫৬
স্বচক্ষে মুক্তিযুদ্ধ না দেখলেও তরুণদের চেতনায় একাত্তর অম্লান। বই, চলচ্চিত্র আর বড়দের মুখে শোনা গল্পেই তারা স্বাধীনতা সংগ্রামকে হৃদয়ে ধারণ করেছে। ক্যাম্পাসের আড্ডা থেকে ব্যক্তিগত ভাবনায়, সর্বত্রই মিশে আছে সেই গৌরব। বিজয়ের মাসে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাবনায় মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের একান্ত অনুভূতিগুলো তুলে ধরেছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মো. সাইফুল ইসলাম।
বিজয় দিবসে আত্মোপলব্ধি ও আগামীর প্রত্যয়
বিজয় দিবস বাঙালির আত্মপরিচয়, ত্যাগ ও বিজয়ের মহাকাব্যিক স্মারক। প্রতিবছর দিনটি আমাকে গভীর আত্মোপলব্ধির মুখোমুখি দাঁড় করায়। সাভার স্মৃতিসৌধের দিকে তাকালে, লাখো শহীদের আত্মত্যাগ ও প্রতিটি জীবনের পেছনে থাকা অদম্য স্বপ্ন আর তাদের পরিবারের সীমাহীন ত্যাগের কথা স্মরণে আসে। এই ভাবনাগুলো আমাকে মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা কোন সহজলভ্য উপহার নয়। এই বিজয় লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ এবং লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এক পবিত্র অধিকার। বিজয় দিবস আমাদের গৌরব, যা আমাদের জাতীয় পরিচয়কে সমৃদ্ধ করে। এছাডাও এই গৌরবের পাশাপাশি থাকে এক গভীর দায়বদ্ধতা। আমরা কি পেরেছি সেই স্বপ্ন পূরণ করতে, যার জন্য এতো প্রাণ ঝরেছিল? এদেশে এখনও ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর বৈষম্য রয়ে গিয়েছে। আমার ভাবনা, এই বিজয় দিবস শুধু উদযাপনের নয় বরং আত্মসমীক্ষার। শহীদদের রক্ত যেন বৃথা না যায়, সেজন্য এমন একটি উন্নত, সম্বৃদ্ধ ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করা হোক এই বিজয় দিবসে, যাতে এই বিজয় অর্থবহ হয়ে ওঠে।
সামিয়া সুলতানা সাবনম,
শিক্ষার্থী, স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়।
বিজয় ও বাঙালির বীরত্ব
ব্রিটিশ শাসনের ২০০ বছর অতিক্রমের পর, যখন পাকিস্তান নামে একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন বাঙালিদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল হয়তো এইবার স্বাধীনতার মুখ দেখা যাবে। মু্ক্তি মিলবে শোষণ ও বঞ্চনার, বাঙালি জাতি হবে উন্নত। কিন্তু বাঙালির এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়, শুরু হলো পুনরায় শোষণ। শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক সবদিক থেকে দমন নীতি। কিন্তু, এ শোষণ-বঞ্চনার তীব্র প্রতিরোধের জন্যেও বাঙালি জাতি দুর্দমনীয়। কারণ, এ জাতি ঐক্যবদ্ধ, সংগঠিত, সংগ্রামী জাতি। দেশকে ভালোবেসে, দেশকে বাঁচাতে তরুণেরা ঝাঁপিয়ে পরলো যুদ্ধে, বোনেরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল, পিতারা দিলেন সাহস, মাতারা দিলেন আশ্বাস বাণী। যার ফলশ্রুতিতে, দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধের ফলে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। বাঙালি জাতির এই বীরত্বের গাঁথা ইতিহাস এখন ও সগৌরবে বিশ্ব মানচিত্রে প্রতিফলিত হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে আমরা দেখি, এভারেস্ট জয়ী নিশাত মজুমদার, মুসা ইব্রাহিম, এ.ম মুহিত, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ। আমরা দেখেছি পূনর্জাগরণ, আমাদের একতা ও চূড়ান্ত প্রতিরোধ, ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন।
‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?’ কবি শামসুর রহমানের কবিতাটি আমাদেরই প্রতিরূপ, স্বাধীনতা পাওয়ার আকাঙ্খা বাঙালি জাতির মধ্যে কতটা তীব্র, স্বাধীনতার জন্যে কত ব্যাকুল, কত সংগ্রামী। এই দীর্ঘ সংগ্রামের পর আমাদের একান্ত অর্জন, যা অবশিষ্ট আছে, সেটাই আমাদের বিজয় ও বীরত্বগাঁথা।
সামিহা আক্তার জুঁই
শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনাবিদ্যা বিভাগ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়।
মুক্তির আলোয় বিজয় দিবস
ডিসেম্বরের আকাশে লাল-সবুজ পতাকা উড়তে দেখলেই মনে হয়, আমি যেন সময়ের স্রোত বেয়ে চলে যাই সেই একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনে। যুদ্ধটা আমি দেখিনি, কিন্তু তার প্রতিটি স্মৃতি গল্প হয়ে আমাকে বড় করেছে, শিখিয়েছে স্বাধীনতার মূল্য, শিখিয়েছে আত্মমর্যাদার মানে। শৈশবে বাবা-মায়ের মুখে যুদ্ধের গল্প শুনে মনে হতো, স্বাধীনতা যেন এক বিশাল পর্বত, যার চূড়ায় উঠতে রক্ত, অশ্রু আর সাহসের বিনিময় দিতে হয়। আজ বড় হয়ে বুঝি, সেই পর্বতে ওঠার পথ ছিল আরও কঠিন। অসংখ্য মা-বাবার সন্তানহারা হওয়ার শোক, নিরস্ত্র মানুষের প্রতিরোধ, আর এক জাতির অম্লান দৃঢ়তা। বিজয় দিবস এলে তাই শুধুই আনন্দ নয়, এক ধরনের আত্মসমালোচনার শব্দ শুনতে পাই। আমরা কি সত্যিই সেই ত্যাগের যথাযথ সম্মান রাখতে পারছি? অন্যায় দেখলে নীরব থাকা কি স্বাধীনতার চেতনা? দুর্নীতি, বৈষম্য বা অসহিষ্ণুতা দেখলে মনে হয়, আমাদের এখনও অনেক পথ বাকি। বিজয় দিবস আমাকে মনে করিয়ে দেয়, দেশপ্রেম মানে শুধু উৎসব নয়; প্রতিদিনের আচরণে ন্যায়, সততা এবং মানবিকতা রক্ষা করা। ১৬ ডিসেম্বর তাই আমার কাছে প্রতিশ্রুতির দিন। নিজেকে নতুন করে শপথ করবার দিন। স্বাধীনতার এই দীপ্ত আলো আমাকে মনে করিয়ে দেয়, ছোট ছোট কাজেও দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায়। দায়িত্ব পালন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, আর সত্যের পাশে থাকা, এসবই হয়তো আমার মতো সাধারণ মানুষের বিজয়ের পথ।
হামিমা মমতাজ আফরিন
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়।
মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান
‘সমাজের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’ বিদ্রোহী কবির লেখা এ দুটি পঙক্তির তাৎপর্য গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের দিকে তাকালে। কী এক দুঃসহ সময় ছিলো! ভয়কে সাহসে পরিণত করে যুদ্ধ করতে সাহস দিয়ে গেছেন লড়াকু নারীরা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১১৪৬ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধে যোগদান করেন। কিন্তু যুদ্ধকালীন সময়ে এছাড়াও লড়েছেন বাংলার প্রত্যেক নারী। কখনো তিন বেলা না খেয়ে, কখনো নিজের স্নেহের পুত্র সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়ে, কখনো মুক্তিযুদ্ধাদের সেবা দিয়ে। অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অবতীর্ণ নারীদের অনেকেই ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলা যুদ্ধ, অস্ত্রচালনা ইত্যাদির প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সারির গেরিলা অপারেশনে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত দুইজন নারী ক্যাপ্টেন সেঁতারা বেগম ও তারামন বিবি এছাড়াও কাঁকন বিবি ছিলেন এমন সম্মুখসারির যোদ্ধা।
নারীরা পিছিয়ে নেই, পিছিয়ে ছিলেন না! তাই তো যুদ্ধে তাদের বিশেষ সহযোগিতা আজ ও শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি আমরা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনেও আবার বিশেষ ভূমিকা পালন করেন এই নারীরা। সকল বাঁধা পেরিয়ে তাদের অনেকেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করেন। নিজেরা স্বনির্ভরতা অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধের নারীরা প্রমাণ করেছেন, জাতীয় সংকটে নারী শুধু ভুক্তভোগী নন, তারা শক্তিশালী সমাধানদাতা এবং পরিবর্তনকারী শক্তি। এই মানসিকতাই বর্তমানের সংকট নিরসনের চাবিকাঠি। সুদৃঢ় ও সুন্দর দেশ গড়তে পুরুষের পাশাপাশি এগিয়ে আসুক সর্বস্তরের নারী। তাই আজো বিজয়ের মাসে বীরাঙ্গনাদের আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
চৈতী রানী রায়
শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়।
বিজয় দিবসে প্রজন্মের প্রতিশ্রুতি
মহান বিজয় দিবস জাতির শক্তি, সাহস ও আত্মমর্যাদার এক অনন্য প্রতীক। এই দিনটি আমার হৃদয়ে জাগায় গভীর শিহরণ। লাল-সবুজ পতাকার প্রতিটি দোলা মনে করিয়ে দেয় বীর শহীদদের রক্তঋণ আর স্বাধীনতার অমূল্য মূল্য। বর্তমান প্রজন্মের কাছে বিজয় দিবসের মানে নতুনভাবে রূপ নিচ্ছে। তারা স্বাধীনতাকে দেখে দায়িত্ব, মানুষকে ভালোবাসা, ন্যায় ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিতে।
প্রযুক্তি-নির্ভর এই প্রজন্ম বিশ্বাস করে দেশ গড়ার সবচেয়ে বড় শক্তি তাদের হাতের মুঠোয়। জুলাই ২৪ চেতনার সঙ্গে বিজয় দিবসের একাত্মতা আরও অনুপ্রেরণাদায়ী। একাত্তর শিখিয়েছে দেশকে ভালোবাসতে, আর জুলাই ২৪ শিখায় নিজেকে তৈরি করে দেশের জন্য কাজ করতে। দুটি চেতনার কেন্দ্রেই আছে দায়িত্ববোধ, মানবিকতা এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের অঙ্গীকার, দেশের প্রতি অকৃত্রিম দেশপ্রেম। বিজয়ের বার্তা একটাই- প্রজন্ম বদলায়, কিন্তু দেশপ্রেমের শিখা কখনো নিভে না।
এস এম এহসানুল কবির আশিক
শিক্ষার্থী, স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়।
বিজয় আমাদের আত্মমুক্তির অঙ্গীকার
বিজয় দিবস আমাদের বাঙালি জাতির চেতনায় এক দীপ্ত প্রত্যয়ের সূর্যোদয়। এই দিনটি আমার কাছে জাতীয় আত্মমর্যাদার প্রতীক। প্রতি বছর যখন দিনটি আসে তখন আমাদের মনে অদ্ভুত এক আবেগ জন্মায়। দিনটি এলেই উপলব্ধি করি, মুক্তির সেই পথ কত দুর্গম ও দুঃসাহসিক ছিল। মহান মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ ও জীবন উৎসর্গ আমার হৃদয়ে এক গভীর শ্রদ্ধার সুর তোলে। তাদের জীবনদান যেন আমাদের কাছে চিরকালীন দায়বদ্ধতার এক নীরব আহ্বান। বিজয় দিবসের দিনটিতে আমাকে ভাবায়, আমরা কি সত্যিই স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করতে পারছি? আমাদের কাজ, আচরণ, মূল্যবোধ কি দেশের অগ্রগতিতে সহায়তা করছে? বীর সন্তানেরা তাদের রক্ত, ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের বিনিময়ে আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন বাঙালি জাতির এই মহিমান্বিত বিজয়ের দিন। বিজয় দিবস তাই আমার কাছে আত্মমুক্তি, আত্মপরিশুদ্ধি ও নতুন অঙ্গীকারের প্রতীক।
সৌরভ আহমেদ সাগর
শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়।
মো. সাইফুল ইসলাম/এসএসকে

