Logo

রাজধানী

রাজধানীতে বাড়ছে ভিক্ষুক, অর্থনৈতিক চাপে রাস্তায় নামছেন অনেকে

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৭

রাজধানীতে বাড়ছে ভিক্ষুক, অর্থনৈতিক চাপে রাস্তায় নামছেন অনেকে

রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সড়ক, মার্কেট এলাকা, বাসস্ট্যান্ড, গির্জা-মসজিদ ও ব্যস্ততম মোড়গুলোতে ভিক্ষুকের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো হারে বেড়েছে। বিশেষ করে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সামনের সড়ক, গুলিস্তান মার্কেট এলাকা, ফ্লাইওভারের নিচের অংশ, বড় বাসস্ট্যান্ডগুলো, ফার্মগেট, বিজয় সরণীর মোড়, যাত্রাবাড়ী মোড়, পুরানা পল্টন, খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে, মিরপুর এবং সিগন্যালযুক্ত বড় বড় মোড়ে প্রতিদিন শত শত ভিক্ষুককে দেখা যায়। এদের মধ্যে আছেন- অসহায়, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ও রোগাক্রান্ত মানুষ; আবার রয়েছে সাজানোপোশাকের পেশাদার ভিক্ষুকের দল, যারা সংগঠিতভাবে ভিক্ষাবৃত্তির জাল বিস্তার করেছে।

অর্থনৈতিক চাপে রাস্তায় নামছেন অনেকে : 

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অর্থনৈতিক চাপ, বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, এবং নি¤œআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় অনেকেই বাধ্য হয়ে রাস্তায় সাহায্য চাইছেন। বিশেষ করে আশ্রয়হীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শ্রমক্ষমতা হারানো ব্যক্তি, এবং বিভিন্ন জেলায় নদীভাঙনে গৃহহারা হওয়া মানুষ ঢাকায় এসে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ছেন।

বায়তুল মোকাররম এলাকার সড়কে কথা হয় ৬০ বছরের রহম আলীর সঙ্গে। 

তিনি জানান, “আগে রাজমিস্ত্রির হেল্পার ছিলাম। বয়স বাড়ায় কাজ পাই না। দুইবার স্ট্রোক হওয়ার পর শরীর আর চলে না- ভিক্ষা ছাড়া উপায় নেই।”

এমন দৃশ্য প্রতিদিনই দেখা যায়- কারও পা নেই, কেউবা তিনচাকার ভ্যান হুইলচেয়ারে বসে সাহায্য চাইছেন। এসব মানুষ অনেকেই প্রকৃত অর্থে সহায়তার অপেক্ষায়।

অন্যদিকে, ভিক্ষাবৃত্তির বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে পেশাদার ভিক্ষুক চক্র। অভিযোগ রয়েছে- সকালে গাড়িতে করে ভিক্ষুক সরবরাহ করা হয় বিভিন্ন মোড়ে, শিশু ভিক্ষুকদের ‘টাইম শিফট’ অনুযায়ী ভাগ করে রাখা হয়। আয় বণ্টনের সুস্পষ্ট নিয়ম রয়েছে। প্রতিবন্ধী সাজানোর জন্য মলম বা নকল ব্যান্ডেজ ব্যবহার করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে শিশু ও নারী পাচারকারীরা ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে সক্রিয় থাকে।

রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ের রিকশাচালক, দোকানদার ও পথচারীদের অভিজ্ঞতায় জানা যায়, সিগন্যাল পড়লেই ৮-১০ জন ভিক্ষুক একসঙ্গে গাড়ির দিকে ধেয়ে আসে- যা প্রমাণ করে এদের বেশিরভাগই সংগঠিতভাবে নিয়ন্ত্রিত।

ট্রাফিক সিগন্যাল ও বাজার এলাকায় জনদুর্ভোগ : বৃহত্তর সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে বড় বড় সিগন্যাল পয়েন্টে- মগবাজার মোড়, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাব, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর টাউনহল- এ প্রতিদিন গাড়ির জানালায় টোকা, নেমে এসে পথ আটকে দাঁড়ানো, কিংবা শিশুকে কোলের ওপর রেখে অনুনয়- এসবের কারণে গাড়িচালক ও যাত্রীরা বিপাকে পড়ছেন।

অনেক সময় হঠাৎ করে রাস্তার মাঝখানে ঢুকে পড়ায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় এক  ট্রাফিক পুলিশ বলেন, “আমাদের বারবার সরিয়ে দিতে হয়, কিন্তু তারা আবার আসে। সংগঠিত চক্র পেছনে থাকায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।”

বাংলাদেশে ১৯৪৩ সালের ঠধমৎধহপু অপঃ অনুযায়ী সংগঠিত ভিক্ষাবৃত্তি দণ্ডনীয়। সরকার মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে, তাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রেও পাঠানো হয়। কিন্তু কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত জায়গা নেই। দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনের কার্যকর কর্মসূচি নেই। ভিক্ষুক চক্রের প্রভাব এতটাই শক্তিশালী যে পুনর্বাসিত ব্যক্তিরা আবার রাস্তায় ফিরে আসে। ফলে সমস্যা থেকে যায় আগের মতোই।

ধর্মীয় ও মানবিক আবেগে বাংলাদেশে অনেক মানুষ রাস্তার ভিক্ষুককে টাকা দেন। বিশেষ করে শুক্রবারে বায়তুল মোকাররম এলাকায় তা বেশি দেখা যায়। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন- “মানুষ সাহায্য করার অভ্যাসে এতটাই অভ্যস্ত যে পেশাদার ভিক্ষুকরাও সুযোগ নেয়। ফলে প্রকৃত দরিদ্রের সাথে পেশাদার চক্র একাকার হয়ে যাচ্ছে।” 

পুনর্বাসন ছাড়া সমাধান নয় : 

দরিদ্র এবং আশ্রয়হীন মানুষদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনই প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে- কর্মসূচি ভিত্তিক কাজের সুযোগ, চিকিৎসা সহায়তা, নিরাপদ আশ্রয়, শিশু ভিক্ষুকদের স্কুলে ফিরিয়ে আনা, পেশাদার চক্র ভাঙতে নিয়মিত নজরদারি- এসব উদ্যোগ না নেওয়া পর্যন্ত ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ কঠিন।

রাজধানীতে ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়ছে- এর মধ্যে আছে প্রকৃত অসহায় মানুষ, আবার রয়েছে নেটওয়ার্কভিত্তিক পেশাদার ভিক্ষুকও।  প্রশাসন চেষ্টা করলেও সংগঠিত চক্র ও অপর্যাপ্ত পুনর্বাসনের কারণে সমস্যাটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। জনদুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে সিগন্যাল ও বাজার এলাকায়।

সামাজিক করুণা, আইন প্রয়োগ ও কার্যকর পুনর্বাসন- এই তিনটি প্রক্রিয়া সমন্বিত না হলে রাজধানীর ভিক্ষাবৃত্তি আরও বাড়বে এমন আশঙ্কাই করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

আইএইচ/ 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ঢাকার খবর

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর