Logo

সারাদেশ

তিতাস নদীতে খননের নামে মাটি ‘লুট’

Icon

লিটন হোসাইন জিহাদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৪২

তিতাস নদীতে খননের নামে মাটি ‘লুট’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদী শুধু একটি জলপ্রবাহ নয়; এটি একটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আবেগের নাম। এ নদীকে নিয়ে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণের একটি কালজয়ী উপন্যাসও রয়েছে। যার নাম ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। এই নদীর ঢেউয়ে একসময় যে প্রাণের স্রোত বয়ে যেত, সেখানে এখন বয়ে চলছে নীরব ‘কান্নার সুর’।

তিতাস নদী আজ যেন জীবন্ত লাশ। দুই পাড়ে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা এবং আবাসিক বর্জ্যের দূষণে নদীর শ্বাসরোধ হচ্ছে। সরাইলের শাহবাজপুর কিংবা নবীনগরের গ্রামীণ পাড়াগুলোতে একসময় যেখান থেকে বিশাল পালতোলা নৌকা ভেসে যেত, সেসব জায়গায় এখন দেখা মেলে ইটভাটার ধোঁয়া আর ময়লার স্তূপ। বিশুদ্ধ পানির পরিবর্তে কালো দূষিত পানি আর মরা মাছের দুর্গন্ধ জানান দেয় নদীর করুণ অবস্থা।

তথ্য অনুযায়ী, তিতাস নদী প্রকল্পের অধীনে ৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ তিতাস নদী এবং এর শাখা নদীর মধ্যে সাড়ে ৯ কিলোমিটার পাগলা নদী, সোয়া ৩ কিলোমিটার করুলিয়া খালসহ মোট ১০৩ কিলোমিটার নদী খননের জন্য ১১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ভেতরে তিতাস নদীর খনন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে বলে কেউ দেখেননি।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, খননের নামে নদীর বালু লুট করা হয়েছে। নদীর মাটি অবৈধভাবে বিক্রির সুবিধার্থে সরাইল ও গুকর্ণঘাটের দিক দিয়ে তিতাস নদীর কিছু অংশ সামান্য খনন করা হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর্কাইভ মিউজিয়ামের সেক্রেটারি মো. ইব্রাহিম খান সাদত জানিয়েছেন, তিতাস নদীর দূষণ প্রধানত শহর ও বাজারকেন্দ্রিক বর্জ্য থেকে সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ছোট-বড় শিল্পকারখানার বর্জ্যও এতে যুক্ত হচ্ছে। শহরের ময়লার ড্রেনগুলো সরাসরি তিতাস নদীর সাথে সংযুক্ত হওয়ায় দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদীর তীরবর্তী মানুষের অসচেতনতার কারণেও নদী দূষণের শিকার হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, নদী পুনর্খননের যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল, তা ছিল দুনীর্তিতে ভরা। খননের সময় উত্তোলিত মাটি অবৈধভাবে বিক্রি করা হয়েছে। শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীর অংশগুলো খনন করা হয়নি। অপ্রয়োজনীয় জায়গা খনন করে লুটপাট করা হয়েছে টাকা।

তিতাস নদী নিয়ে কাজ করা সংগঠন তরী বাংলাদেশের আহ্বায়ক শামীম আহমেদ বলেন, তিতাস নদী খনন প্রকল্প নিয়ে যে তথ্য জানা যায়, তা হলো প্রায় দেড়শ কোটি টাকা ব্যয়ে নদী খনন করা হয়েছে। তবে এই খনন কার্যক্রম শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। তিতাস নদীর তীরবর্তী মানুষ জানেই না, কীভাবে এই খনন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। শহরের অংশে তো খননযন্ত্র আসেইনি। প্রকৃতপক্ষে, খননের নামে সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে, আর নদীর বালু লুটপাট হয়েছে।

শামীম আহমেদ অভিযোগ করেন, ‘তিতাস নদী থেকে উত্তোলিত বালু ফসলি জমিতে ফেলা হয়েছে। এতে ফসলি জমি ও বিল ধ্বংস হয়েছে। কিছু সুবিধাবাদী ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থে এই কাজ করেছেন, যা প্রশাসনের সামনেই ঘটেছে। যেসব ব্যক্তি সরকারের ছত্রছায়ায় ছিলেন, তারা একাধিক ড্রেজার ব্যবহার করে তিতাসের বালু চুরি করেছেন। সঠিকভাবে খনন হলে নদীর নাব্যতা সংকট দেখা দিত না। বর্তমানে তিতাস নদীতে নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, বিআরবিডব্লিউ তাদের জেটি প্লাটফর্মগুলো সরিয়ে নিয়েছে। জাতিসংঘের দেওয়া এই প্লাটফর্মগুলো ইজারা দেওয়ার অভিযোগে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে তিতাসে নৌপথ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

তিতাস নদীতে মাছের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি অপেশাদার জেলেদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। কারেন্ট জাল, রিং জাল এবং বিদ্যুতের শক ব্যবহার করে মাছ ধরা হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ অমানবিক।

শামীম আহমেদ বলেন, যারা নদী নিয়ে কাজ করি, আমরা বিভিন্ন মিটিংয়ে এসব সমস্যার কথা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। অভিযানের দাবিও জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো অভিযান পরিচালিত হয়নি। গত তিন বছর ধরে জেলা নদী রক্ষা কমিটির মিটিংয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভাকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তারা উপস্থিত হয়নি।

তিতাস নদীর এমন পরিস্থিতি পরিবর্তনে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান শামীম আহমেদ।

কখনো জোয়ার-ভাটার ছন্দে নেচে ওঠা তিতাসের ঢেউগুলো এখন নিস্তেজ। জেলেরা নদীর সঙ্গে ছিল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাদের জন্য তিতাস ছিল জীবিকা ও সংস্কৃতির আশ্রয়। কিন্তু এখন মাছ ধরার জালও যেন অভিশপ্ত হয়ে উঠেছে। মাছ নেই, নেই নৌকার তালের কোলাহল। নদীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে পালতোলা নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার।

তিতাস নদীতে মাছ ধরেন সংকর নামের এক জেলে। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, তিতাসে আর আগের মতো মাছ নেই। জাল ফেললেই প্লাস্টিকের বর্জ্য চলে আসে। পানিতেও গন্ধ করে। মাছ ধরে এখন আর জীবিকা নির্বাহ করার সুযোগ নেই।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বিমল চক্রবর্তী বলেন, তিতাস নদী দূষণের প্রধান কারণ হলো আবাসিক বর্জ্য। শহরের বেশিরভাগ বর্জ্য সরাসরি তিতাস নদীতে ফেলা হচ্ছে, যা পুরোপুরি পৌরসভার দেখভালের দায়িত্ব।

তিনি বলেন, ‘যদি নদী দূষণের কারণ শিল্পকারখানার বর্জ্য হতো, তাহলে পরিবেশ অধিদপ্তর পদক্ষেপ নিতে পারত।’ তবে পৌরসভার এমন কর্মকাণ্ডে পরিবেশ অধিদপ্তর কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সরকারের একটি বিভাগ আরেকটি বিভাগের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে কোনো কার্যকর ফলাফল আসবে না।’

তিতাসের বুকে অবস্থিত মালোপাড়া; যেখানে নদীর সন্তানরা একদিন নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছিল জীবনযাত্রা। তারা এখন বেঁচে থাকার জন্য ছুটছে ভিন্নপথে। তিতাসের জল আর তাদের জীবন ছুঁতে পারে না। তাদের কান্না আজ নদীর বুকের বোবা কান্নার প্রতিধ্বনি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার বর্তমান প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, পৌরসভা নিয়মিতভাবে বাসাবাড়ি ও আবাসিক এলাকা থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্য নির্ধারিত স্থানে ফেলে। পৌরসভার পক্ষ থেকে কোনো বর্জ্য নদীতে ফেলা হয় না।

তিনি আরও বলেন, যদি নির্দিষ্টভাবে কেউ অভিযোগ করেন যে নদীতে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে, তাহলে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিতাস নদী দূষণ রোধে সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে।

  • এমজে
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর