শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকদের ভরসা ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতাল

হাসান ভূঁইয়া, আশুলিয়া
প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৯:২৫

ছবি : বাংলাদেশের খবর
দেশে স্বল্প খরচে স্বাস্থ্যসেবা পেতে নিম্নবিত্ত পরিবারের মূল ভরসা এখনো সরকারি হাসপাতাল। তবে বেসরকারি খাতে চিকিৎসাসেবার খরচ ব্যয়বহুল হলেও এ খাতে অংশগ্রহণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। যদিও সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা পর্যাপ্ত না থাকায় অনেকটা বাধ্য হয়েই বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন মানুষ।
এমন চিত্র দেখা যায় দেশের সবচেয়ে জনবহুল এলাকা শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায়। যেখানে এখনো একটি সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থা করতে পারেনি দেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সাভার উপজেলায় প্রায় ৩০ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। সেখানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছাড়া অন্য কোনো সরকারি হাসপাতাল নেই। তাও আবার মাত্র ৫০ শয্যার।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি সাভার থানাধীন এলাকায় অবস্থিত। যার ফলে আশুলিয়ার শ্রমিকরা সেখানে খুব একটা যান না। অন্যদিকে আশুলিয়ায় নেই কোনো সরকারি হাসপাতাল। তাই এখানে একটি সরকারি হাসপাতালের দাবি আশুলিয়ায় কর্মরত শ্রমিকদের।
দেশে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় সংগঠন বিজিএমইএ। পোশাক শ্রমিকদের জন্য আশুলিয়ায় বিজিএমইএ’র একটি হেল্প সেন্টার থাকলেও সেখানে ভালো কোনো চিকিৎসক না থাকায় অনেকে সেখানে যান না। তবে বেশির ভাগ শ্রমিকই এ হেল্প সেন্টারের তথ্য জানেন না।
অন্যদিকে, শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার সাধারণ মানুষ, সচেতন মহল, শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের দাবি—বাংলাদেশে নতুন করে চীনের যে তিনটি বিশেষায়িত হাসপাতাল করার প্রস্তাব রয়েছে, তার মধ্যে একটি যেন আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চলে করা হয়।
আশুলিয়ায় কর্মরত শ্রমিকরা জানান, যে কোনো ধরনের রোগের জন্য আমাদের বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হয়। কারণ আশুলিয়ায় কোনো সরকারি হাসপাতাল নেই। কিন্তু আমরা যে পরিমাণ বেতন পাই, তা দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানো আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। কারণ আপনারা জানেন, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ অনেক ব্যয়বহুল।
স্বল্প খরচে আশুলিয়ায় কর্মরত শ্রমিকদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে একটি সরকারি হাসপাতালের বিকল্প নেই বলেও তারা জানান।
হামীম গ্রুপের সন্তানসম্ভবা নারী শ্রমিক রোজিনা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আমি দুই দিন আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমাদের অফিসের ডাক্তার আমাকে দেখে বলেন একজন গাইনি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে। তাই আমি জামগড়া একটি প্রাইভেট হাসপাতালে যাই। সেখানে গেলে নানা পরীক্ষা করে মোটা অঙ্কের একটি বিল ধরিয়ে দিলো। কত টাকা বেতন পাই বলেন!’
তিনি আরও বলেন, ‘ডাক্তার বলেছে এক মাস পরেই ডেলিভারির তারিখ। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে যে খরচ, তা নিয়ে রীতিমতো হতাশার মধ্যে দিন পার করছি। আশুলিয়ায় একটি সরকারি হাসপাতাল থাকলে আমাদের মতো শ্রমিকদের অনেক উপকার হতো।’
সরকারি হাসপাতালের দাবি জানিয়ে রোজিনা বলেন, ‘আমি বর্তমান সরকারের কাছে আপনাদের মাধ্যমে আবেদন জানাই—তিনি যেন শ্রমিকদের কথা মাথায় রেখে আশুলিয়ায় একটি সরকারি হাসপাতাল করেন।’
রিকশাচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, আমার ভাগিনার হঠাৎ বুকে ব্যথা হয়। পরে তাকে নিয়ে আশুলিয়ার সরকার মার্কেট এলাকার একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। ডাক্তার দেখেই ভর্তি করতে বলেন। কিছুক্ষণ পরেই বলেন তাকে আইসিইউতে নিতে হবে। উপায় না পেয়ে রাজি হয়ে যাই। কিন্তু দুই দিন না হতেই ৭৪ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দিলো। পরে নিজ জিম্মায় রোগীকে নিয়ে গ্রামে পাঠিয়ে দিই।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের বিল, পরীক্ষা মিলিয়ে প্রায় লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত বিল পরিশোধ করতে আমাকে ঋণ করতে হয়েছে।
ইথিক্যাল গার্মেন্টসের পোশাক শ্রমিক মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কিছুদিন আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হই। তখন আমার প্লাটিলেট অনেক কমে যায়। তখন আমাদের কারখানার ডাক্তার হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। আমি কি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করাতে পারি? কত টাকা বেতন পাই আমি! তাই কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি হই। তবে আশুলিয়া থেকে যাওয়া-আসা অনেক কষ্টকর ছিল। আশুলিয়ায় যদি একটা সরকারি হাসপাতাল থাকতো তাহলে আমার মতো অনেক গরিব মানুষ চিকিৎসা নিতে পারত।’
শ্রমিক নেতা সরোয়ার হোসেন বলেন, বিজিএমইএসহ সরকারি বিভিন্ন মাধ্যমে অনেকবার আমরা অনুরোধ করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আশুলিয়ায় কোনো সরকারি হাসপাতালের কার্যক্রম দেখছি না। উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর খরচ এত বেশি যে শ্রমিকদের পক্ষে সেখানে চিকিৎসা করানো প্রায় অসম্ভব।
এ সময় তিনি চীনের প্রস্তাবিত তিনটি বিশেষায়িত হাসপাতালের মধ্যে একটি আশুলিয়ায় স্থাপনের দাবিও জানান।
সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌহিদ আল হাসান বলেন, আশুলিয়ায় একটি সরকারি হাসপাতাল স্থাপন করা খুবই জরুরি। হাসপাতাল স্থাপনের জন্য জমির প্রয়োজন। যদি কেউ জমি দান করতে চান, সেক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রস্তাব পাঠাবো। পাশাপাশি খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে, আশুলিয়ায় সরকারি খাস জমি কোথায় পাওয়া যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের একটি মাসিক সমন্বয় সভা হয়। সেখানে ঢাকা জেলার সিভিল সার্জনসহ হেলথ ডিপার্টমেন্টের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকেন। সেখানে আমি এ বিষয়টি উত্থাপন করবো। যদি সরকারের নতুন কোনো হাসপাতাল করার ইচ্ছে থাকে, তাহলে তা যেন আশুলিয়ায় হয়—এ প্রস্তাবনা আমি দেবো।
এমবি