সরকারি, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী চক্রের দখলে ভৈরব নদ

বাগেরহাট প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:৩৩

ছবি : বাংলাদেশের খবর
‘রক্ষার বদলে বছরের পর বছর নদী মারতেই শত আয়োজন উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে’—আক্ষেপ করে এসব কথা বলছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা হাসান মাহমুদ জসিম। তিনি একটি স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত।
মাহমুদ জসিম বলেন, ‘মুখে নদী রক্ষার কথা বললেও বাস্তবে সবাই নদী-খাল-জলাধার হত্যায় ব্যস্ত।’
২০১৭ সালে বাগেরহাটে ভৈরব নদ রক্ষায় মহা আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। পরে জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে নদীর তীরের অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করে। উচ্ছেদ শেষে নদী রক্ষায় বৃক্ষরোপণ ও সামাজিক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ওই সমাবেশে অংশ নেন শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষ। তারা নদী রক্ষার শপথও নেন। কিন্তু শপথ নেওয়ার পর থেকেই বাগেরহাটবাসী সেই শপথ প্রতিনিয়ত ভেঙে চলেছে।
স্থানীয় শহিদুল ইসলাম বলেন, ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান থেকে রাষ্ট্র—কেউ এ শপথ মানেনি। আজ প্রায় সাড়ে সাত বছর পর আমাদের নদী আরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, সরকারি দপ্তর, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী—সবার মধ্যে নদী দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। আর তারা মুখে নদী রক্ষার কথা বলছে।
ভৈরব নদ বাগেরহাট শহরের উত্তর দিক থেকে এসে সুপারি পট্টি খেয়াঘাটের কাছ দিয়ে পূর্ব দিকে চলে গেছে। দক্ষিণে প্রবাহিত এ নদের অংশ দড়াটানা নদী নামে পরিচিত। নদের পশ্চিম তীরে রয়েছে বাগেরহাট শহর ও জেলার প্রধান বাজার। এখান থেকে তীর ধরে গেলে উত্তর-দক্ষিণ দুই দিকেই দেখা যায় ময়লার স্তূপ। একদিকে অবৈধ দোকানঘর, কাঁচাবাজার, ডেকোরেটরের মালামালসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা তীর দখল করে রেখেছে। অন্যদিকে বাজার থেকে মুনিগঞ্জ পর্যন্ত কাঠ, ইট ও বালু ব্যবসায়ীদের দখলদারিত্ব দেখা যায়। পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন নালা থেকেও বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নদীতে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের ডাকবাংলো এলাকায় ভৈরব নদের প্রায় ২৫ ফিট ভেতরে স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভের নামে নির্মিত সেই অবকাঠামোর পর নদীর পশ্চিম পাড়ের বড় একটি এলাকায় চর পড়ে গেছে। ফলে নদীর প্রবাহ আরও সংকুচিত হয়েছে।
এছাড়া দড়াটানা-ভৈরব নদের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য স্থাপনা গড়ে উঠেছে এবং দখলদারিত্ব এখনো অব্যাহত। প্রায় সাত বছর আগে দড়াটানা নদীর ভদ্রপাড়া খেয়াঘাট পাড়ে নদীর মাঝখানে নির্মাণ করা হয় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স। পাশের নদী বাঁকের বড় চরটি দখল করে বালু ফেলে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে একটি পার্ক। ফলে নদীর ওই অংশ হারিয়েছে প্লাবনভূমির বৈশিষ্ট্য।
পার্ক থেকে প্রায় ৩০০ মিটার দক্ষিণে নতুন করে নদীর মাঝে সম্প্রতি একটি স্থাপনা নির্মাণ করেছে মৎস্য বিভাগ। ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ’ প্রকল্পের অধীনে জেটি নির্মাণের নামে নদীর প্রায় ২০ ফিট ভেতর পর্যন্ত পাইলিং করে আটকে দেওয়া হয়েছে প্রবাহ।
নির্মাণকাজের সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাগেরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আল-বিরুনী জানান, এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তর থেকে আমাদের কোনো চিঠি দিয়ে অবহিত করা হয়নি বা অনাপত্তি পত্র চাওয়া হয়নি। যদিও এটি সরকারি প্রকল্পের কাজ। তবে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এমন যেকোনো কিছুতে সম্মতি দেওয়ার সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে মৎস্য বিভাগের দায়িত্বশীলরা দাবি করেছেন, ‘এ প্রকল্প ঢাকা থেকে অনুমোদিত হয়েছে। তারা জানতেন না নদী কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।’ তারা আরও জানান, ‘এ কাজে নদীর কোনো ক্ষতি হচ্ছে না।’
সুশীল সমাজের অনেকেই এ সরকারি প্রকল্পের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বেলা’র খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, ‘যেখানে নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে মূল্যায়ন করে নদী সংরক্ষণের কথা বলা হচ্ছে। সেখানে এ ধরনের কার্যক্রম সরকারি প্রকল্পকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।’
এ বিষয়ে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক আহমেদ কামরুল হাসান বলেন, জেলায় যেসব নদী-খাল দখল ও দূষণে হুমকির মুখে রয়েছে, আমরা সে বিষয়ে দ্রুত খোঁজ নেব এবং প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
নদী রক্ষায় সরকারের শপথ ও উদ্যোগগুলো বাস্তবে ভেঙে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও জনগণের সমন্বিত প্রয়াস ছাড়া বাগেরহাটের নদীগুলোর ভবিষ্যৎ অত্যন্ত শঙ্কার মধ্যে রয়েছে।
শেখ আবু তালেব/এমবি