
খুলনার কয়রায় জামায়াত কর্মী জাহিদুল ইসলাম হত্যা মামলার আসামিদের চেনেন না বাদী। এমনকি কারা আসামি সেটিও মামলার আগে জানতেন না। জামায়াত ইসলামের সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের বাইরে একটি গ্রুপ বাদীকে প্রভাবিত করে মামলা করিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ওই গ্রুপের মূল হোতা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়রা উপজেলার আহ্বায়ক গোলাম রব্বানী। তিনি বাদীকে ফুঁসলিয়ে সুকৌশলে মামলাটি করান বলে অভিযোগ উঠেছে।
মামলা সূত্রে জানা যায়, জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশের প্রতিবাদে খুলনার কয়রায় ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিল করে দলটির কয়রা উপজেলা শাখা। সেটি প্রতিহত করতে তখন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্বে হামলা হয়। ওই সময় মিছিলের লোকজনকে লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে বেশ কিছু আসামি। এ ছাড়া অন্য আসামিরা নানাভাবে হামলা চালায়। ওই ঘটনায় ২৯ জন আহত হন এবং বাদীর স্বামী জাহিদুল ইসলাম বুকসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে পিস্তল ও বন্দুকের গুলি বিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে নিহত হন।
গত ১৭ এপ্রিল সাবেক দুই সংসদ সদস্য সোহরাব সানা ও আক্তারুজ্জামান বাবুসহ ১১৩ জনকে আসামি করে কয়রা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি করা হয়। আসামিদের মধ্যে কয়রা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেনসহ আওয়ামী ও সহযোগী সংগঠনের পদ-পদবি নেই- এমন বেশ কিছু মানুষের নাম রয়েছে।
বেশ কিছু আসামি নিরপরাধী দাবি করে স্থানীয় জামায়াত নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। এ ছাড়া নিন্দা জানিয়ে কয়রা প্রেসক্লাব ও বাংলাদেশ মানবাধিকার ব্যুরোর কয়রা উপজেলা শাখা বিবৃতি দিয়েছে।
মামলার বাদী ওই ঘটনায় নিহত জামায়াত কর্মী জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী ছবিরন নেছা। তিনি জানান, মামলায় আসামি কারা সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। তাকে কাগজে স্বাক্ষর দিতে বললে তিনি স্বাক্ষর দেন।
মামলার বাদী ছবিরন নেছার বাড়ি কয়রা উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামে। রোববার (১৯ এপ্রিল) সকালে ছবিরন নেছার বাড়িতে গিয়ে তার ও পরিবারের সাথে কথা হয়। ওই সময় ছবিরন নেছা বলেন, ‘মামলার দিন গোলাম রব্বানী ফোন করে উপজেলা সদরে ডেকে নেন। গোলাম রব্বানী জামায়াত নেতাদের সাথে চলাফেরা করেন। আমি কয়রা আদালতে পৌঁছে দেখি কয়রা সদর ইউনিয়ন জামায়াতের আমির মিজান ভাই আর উকিলরা সেখানে আছে। উকিলদের আমি চিনি না। মামলার কাগজ আমাকে তারা পড়তেও দেননি। আমি শুধু স্বাক্ষর করেছি। উকিলদের কারা ডেকেছে তাও আমি জানি না।‘
আদালতে দাঁড়িয়ে বিচারক মামলায় ক’জন আসামি জানতে চাইলে তা বলতে পারেননি জানিয়ে ছবিরন নেছা বলেন, ‘আমি তো মামলা সম্পর্কে কিছুই জানি না, কী উত্তর দেব! বিচারক পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, মামলার প্রথম নম্বর আসামির নাম বলেন? আমি তো সেটাও জানি না। তাই বলতেও পারিনি।’
মামলায় জাহিদুল ইসলাম ঘটনাস্থলে নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হলেও বাদী ছবিরনের দাবি, তার স্বামী ঘটনাস্থলে মারা যাননি। গুলিবিদ্ধ হয়ে কয়েক মাস চিকিৎসা নিয়ে তারপর মারা গেছেন। তখনকার সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন।
ছবিরন বলেন, ‘মামলাটি যেহেতু হয়েছে, ভাবলাম স্বামী হত্যার বিচার পাব। তবে এখন শুনছি, অনেক নিরপরাধ মানুষও মামলায় আসামি হয়েছে। আমি তো কারো নাম দিইনি। মামলাটা আমি ব্যক্তিগতভাবে করলে আমার পরিবার ও আশেপাশের যারা আছেন, তাদের জানিয়ে করতাম, এমন ঝামেলা হতো না। আমি চাই দোষীদের বিচার হোক, অহেতুক কোনো নিরপরাধ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়।’
ছবিরন নেছার মুঠোফোন থেকে তাকে মামলা করতে ডাকা ফোন নম্বর নিয়ে দেখা যায় সেটি কয়রা উপজেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক গোলাম রব্বানীর।
গোলাম রব্বানী মামলা করতে ডাকার আগের দিনও বাদীসহ কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে স্থানীয় একটি প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের ব্যবস্থা করেন বলেও জানান সবিরন।
ইতোমধ্যে গোলাম রব্বানীর বিরুদ্ধে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদাবাজি, একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। কিছুদিন আগে তাকে আহ্বায়ক পদ থেকে অপসারণের জন্য একই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা উপজেলা সদরে বিক্ষোভ করেন।
ওই সময় তারা বলেন, ‘কোথাও কোনো আন্দোলন না করেও সুকৌশলে গোলাম রব্বানী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়রা উপজেলার আহ্বায়ক পদ বাগিয়ে নেয়। সরকার পতনের পর থেকে নিজেকে সমন্বয়ক ঘোষণা করে একের পর এক অপকর্ম করে যাচ্ছে। কেউ তার কথার বাইরে গেলেই বিভিন্নভাবে হয়রানি করছে।’
নিহত জামায়াত কর্মী জাহিদুল ইসলামের চাচাতো ভাই কয়রার নারায়নপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. বাবুল আক্তার বলেন, ‘ছবিরন নেছা সম্পর্কে আমার বোন হয়। আমার ভাই মারা যাওয়ায় পর থেকে ওদের পরিবারের সব বিষয়ে জামায়াত দলীয়ভাবে সহযোগিতা করে। মামলা করার দিন জামায়াত নেতারা দলীয়ভাবে ডাকছে ভেবে বোনটা গিয়েছিল। মামলার পর পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা এসেছিলেন আমাদের এখানে। আমরা বলেছি, মামলায় নির্দোষ কেউ যেন হয়রানি না হয়।’
মামলার বাদী ছবিরনের ভাই মো. উজ্জ্বল হোসেন ও তার মা বলেন, ‘মামলা করলে তো আর তিনি ফিরে আসবেন না। আর অনেক আগের ঘটনা। এ জন্য আমরা মামলা করতে চাই না। এখন শুনেছি, অনেককে আসামি করা হয়েছে। অনেকে অনেক কথা বলছে। আমরা নিরীহ মানুষ, কোনো নিরপরাধী হয়রানির শিকার হোক, সেটি চাই না।’
এ বিষয় জানতে গোলাম রব্বানীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি মিটিংয়ে রয়েছেন, পরে কথা বলবেন বলে জানান। তবে পরবর্তীকালে তিনি কল রিসিভ না করায় কথা বলা সম্ভব হয়নি।
কয়রা সদর ইউনিয়ন জামায়াতের আমির মিজানুর রহমান বলেন, ‘মামলার আসামি তালিকার ৪৯ নম্বরে আবু হুরায়রা খোকন নামে আমাদের দলের এক কর্মীর নাম দেওয়া হয়েছে। এই সংবাদ শুনে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। আমি শুধু ওই নাম কেটে দিয়ে আসি। এর বাইরে মামলা সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই। অন্য আসামিদের নামও আমি দেখিনি। ওই সময়ের আগে বাদীর সাথে আমার কথা হয়নি। তবে শহীদ পরিবার হিসেবে আমরা বাদী পরিবারকে সহযোগিতা করি।’
খুলনা জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা এমরান হুসাইন বলেন, ‘কয়রার মামলার ঘটনাটি আমাদের সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে হয়নি। বাদী অন্য কারোর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মামলাটি করতে পারেন। তারপরও মামলার পেছনে আমাদের সংগঠনের কেউ জড়িত আছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অনেক আগের ঘটনায় মামলা করতে গিয়ে নিরীহদের নাম যুক্ত হওয়ার শঙ্কায় খুলনার কোনো উপজেলায় আমরা মামলা করিনি।’
মামলার আইনজীবী মো. শামীমুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের কাছে যে কেউ আসতে পারেন। বাদী আমার কাছে আসা আর না আসা পরের ব্যাপার। বাদীর সাথে কে যোগসূত্র করে দিয়েছে, এটি ব্যক্তিগত বিষয়। এটি বলা যাবে না। আর বাদীর জবানবন্দি অনুযায়ী মামলায় আসামি করা হয়েছে।’
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন সহায়তা প্রদানকারী সংস্থার কয়রা উপজেলা শাখার সভাপতি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে কয়রা থানায় নথিভুক্ত করতে আদেশ দিয়েছেন। অথচ বাদী আসামিদের চেনেন না। এ মামলায় কয়রা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেনসহ কয়রায় কর্মরত কয়েকজন সংবাদকর্মী ও বেশ কিছু নিরীহ মানুষকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ও হয়রানি এড়াতে পরিবার ফেলে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমরা সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে নিরপরাধ মানুষদের হয়রানিমূলক মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদান করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনা জেলার আহ্বায়ক তাসনিম আহমেদ দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের কয়রার নেতৃত্ব নির্বাচন সঠিক হয়নি। এ জন্য লজ্জিত। কয়রার মানুষের কাছে ক্ষমা চাই। দ্রুতই কয়রার কমিটি বাতিল করে পুনরায় ঢেলে সাজানো হবে।’
তরিকুল ইসলাম/এমজে