Logo

সারাদেশ

সুন্দরবনে থামছে না হরিণ শিকার, ধরাছোঁয়ার বাইরে শিকারিরা

Icon

এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, মোরেলগঞ্জ (বাগেরহাট) সংবাদদাতা

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৩০

সুন্দরবনে থামছে না হরিণ শিকার, ধরাছোঁয়ার বাইরে শিকারিরা

বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে হরিণ শিকারে মেতে উঠেছে কয়েকটি চক্র। সম্প্রতি এ চক্রগুলো বেশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যে মাংস বহনকারীরা ধরা পড়লেও চক্রের মূল শিকারিরা রয়ে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু শিকারিদের হাতে দিনের পর দিন নিধনের ফলে কমছে হরিণ। 

হরিণ শিকারের সঙ্গে সুদীর্ঘকাল ধরে কিছু অসাধু ও শক্তিশালী মানুষ জড়িত। শীত মৌসুমে সুন্দরবন সংলগ্ন খালের পানি শুকিয়ে যায়। যে কারণে সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে চলে আসে হরিণের পাল। আর এই সুযোগই কাজে লাগান হরিণ শিকারিরা। বনের আশপাশের এলাকার শিকারিরা বেপরোয়া হয়ে নিয়মিত হরিণ শিকার করে গোপনে মাংস বিক্রি করেন। আর গরু ও খাসির মাংসের তুলনায় হরিণের মাংসের দাম কম হওয়ায় সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় এই বন্যপ্রাণীর মাংসের চাহিদা বাড়ছে। 

সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং চিত্রল ও মায়া হরিণ। সাধারণ মানুষের আকর্ষণ ও গুরুত্বের দিক দিয়ে বাঘের পরেই চিত্রল ও মায়া হরিণের অবস্থান। কিন্তু তাদের নিয়মিত শিকারে কমছে হরিণের সংখ্যা। বনে শিকার বন্ধ এবং শিকারিদের ধরতে বন বিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকলেও থামছে না হরিণ নিধন।

গত এক মাসে কোস্টগার্ডের হাতে উদ্ধার হয়েছে ১২ মণ হরিণের মাংস। আটক হয়েছে ৯ হরিণ শিকারীসহ হরিণ ধরা ফাঁদ ও ট্রলার। সুন্দরবনের কচিখালি হরিণ পাচারের এখন নিরাপদ রুট। অভিযান সত্ত্বেও হরিণ নিধন ও পাচার না থামায় বনরক্ষীদের ভূমিকা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। 

হরিণ শিকারের জন্য এই চক্রটি সব সময় সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের হতদরিদ্র, লোভী জেলে ও অসাধু বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহার করে। সামান্য আর্থিক লাভের আশায় তারাও ব্যবহৃত হচ্ছেন যুগের পর যুগ। সাম্প্রতিক সময়ে এই চক্রটি খুব বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই চক্রকে দমন করতে বনবিভাগের পাশাপাশি পুলিশও অভিযান শুরু করেছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সরাসরি হরিণ শিকারের সাথে জড়িতরা ধরা পড়লেও অধরা থেকে যাচ্ছেন মূল হোতারা।

বনজীবীদের দাবি- বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ ছাড়া সুন্দরবনের অভ্যন্তরে কোনো অপরাধ করা সম্ভব নয়। সুন্দরবন ও বনের বন্য প্রাণি রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধিসহ জেলে, বনজীবী ও স্থানীয়দের মাঝেও সচতেনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।

বন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সাম্প্রতিক কালে সুন্দরবন থেকে হরিণ পাচার বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি সংঘবদ্ধ হরিণ শিকারী চক্র প্রতিনিয়ত সুন্দরবনে হরিণ শিকার করে চলেছে। সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কচিখালি, চান্দেশ্বর, ডিমের চর এবং শরণখোলা উপজেলার পানির ঘাট ও সোনাতলা এলাকা হরিণ পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বরগুনার পাথরঘাটার চরদোয়ানি, কাঠালতলি ও জ্ঞানপাড়া এলাকার একটি সংঘবদ্ধ হরিণ শিকারী চক্র রাতের আধারে সুন্দরবনের কচিখালি, চান্দেশ্বর, ডিমেরচর এলাকা দিয়ে প্রতিনিয়ত ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে। 

অপরদিকে শিকারীরা সুন্দরবন থেকে হরিণ শিকার করে এনে শরণখোলার সোনাতলা, পানিরঘাট এলাকা দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় হরিণের মাংস পাচার করছে। গত ১৫ এপ্রিল কোস্টগার্ড দক্ষিণ জোন পাথরঘাটার সদস্যরা পাথরঘাটা কাঠালতলী এলাকা থেকে ৩৫ কেজি হরিণের মাংসসহ এক শিকারীকে আটক করে। আটক শিকারীর নাম রেজাউল ইসলাম (২৫)। তার বাড়ি পাথরঘাটার হোসেনপুর গ্রামে। 

এ ঘটনা ছাড়া বাংলাদেশ কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনর মোংলার সদস্যরা গত এক মাসের মধ্যে পৃথক পৃথক অভিযানে আটজন হরিণ শিকারীকে আটক করে। এ সময় উদ্ধার করে ৪২৩ কেজি হরিণের মাংস। জব্দ করে বিপুল পরিমাণ হরিণ ধরা ফাঁদ ও কয়েকটি ট্রলার। এর মধ্যে ১৮ এপ্রিল মোংলা জয়মণি থেকে ৩১ কেজি হরিণের মাংস ও একটি মাথা। ১১ এপ্রিল জয়মণি বালুর মাঠ থেকে ২৪ কেজি মাংস, হরিণের চামড়া ও একটি নৌকা, ৮ এপ্রিল নলিয়ান ঠাকুরবাড়ি এলাকায় ১১০ কেজি মাংস ২টি নৌকা ও আরিফুল সরদার (২৪) নামে একজন শিকারী আটক হয়। 

১৬ মার্চ মোংলার জয়মণি ও শ্যামনগরের সুন্দরবন বাজার এলাকায় উদ্ধার হয় ২০৫ কেজি হরিণের মাংস, ২টি মাথা, ২টি চামড়া। এ ঘটনায় বাবু আলম (২৭) নামে একজন শিকারী আটক হয়। ১৪ মার্চ নলিয়ান বালুর মাঠ এলাকায় উদ্ধার করা হয় ২৮ কেজি মাংস। এই ঘটনায় জয়নাল গাজী (২৫) নামে একজন শিকারী আটক হয়। 

এ ছাড়া ১২ মার্চ সুন্দরবনে মরালক্ষি খাল থেকে হরিণ ধরার ৮০টি ফাঁদসহ আটক হয় ৫ শিকারি। এ সময় জব্দ করা হয় ২৫ কেজি হরিণের মাংস। আটক শিকারিরা হচ্ছেন- ইমরান গাজী, আ. রহিম, রোকনুজ্জামান, আবু মুসা ও মো. মামুন। এদের বাড়ি কয়রা এলাকায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের জেল থেকে ছাড়া পাওয়া এক ব্যক্তি বলেন, আমরা সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতাম। লোভে পড়ে হরিণের মাংস বহন করতে গিয়ে ধরা পড়েছি, জেল খেটেছি, জরিমানা দিয়েছি। কিন্তু হরিণ শিকার তো থামেনি, আমাদের জায়গায় এসেছে নতুন মানুষ, রাঘব বোয়ালরা রয়ে গেছে অগোচরে। যারা আমাদের মতো অসহায়দের অর্থের লোভ দিয়ে ব্যবহার করে, আপনারা তাদেরকে ধরুন। 

সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে বাঘ-হরিণ হত্যার বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। হরিণের মাংস, হরিণের চামড়া ও বাঘের চামড়া উদ্ধার হচ্ছে। একটি অসাধু চক্র এর সাথে জড়িত রয়েছে। এর পেছনে গডফাদারের পাশাপাশি বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত। এদেরকে অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় আনতে হবে। বনরক্ষীদের টহল বৃদ্ধি করতে হবে। লোকালয় সংলগ্ন বনে কাঁটাতারের বেড়া দিতে হবে। এখনই যদি বাঘ ও হরিণ শিকার বন্ধ না করা যায় তাহলে সুন্দরবন থেকে বাঘের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।

সুন্দরবনের দস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার অন্যতম ভূমিকা পালনকারী সাংবাদিক যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মোহসিন উল হাকিম বলেন, সুন্দরবন একটি বিস্তৃত জায়গা, সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী হত্যা ও নিধন কমাতে বনবিভাগের গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। বনবিভাগের কাছে শিকারিদের যে তালিকা রয়েছে, তাদেরকে বনে প্রবেশের জন্য পাস পারমিট বন্ধ করতে হবে। যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তি সুন্দরবনের অপরাধ কর্মের সাথে জড়িত তাদেরকেও বনবিভাগের তালিকায় এনে নজরদারিতে রাখতে হবে। হরিণ শিকারের পেছনে যে প্রভাবশালীরা রয়েছে তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। হরিণ শিকারের অপরাধের জন্য শাস্তির পরিমাণও বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেন তিনি। 

বাগেরহাট রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি এস.এম. সাইফুল ইসলাম সুন্দরবন থেকে হরিণ পাচারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, কোস্টগার্ডের হাতে একের পর এক হরিণের মাংস উদ্ধার হলেও বনবিভাগের কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। সুন্দরবনের বন্য প্রাণী রক্ষা ও বন ভিত্তিক অপরাধ কমাতে স্থানীয়দের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করতে হবে। বনসংলগ্ন লোকালয়ের মানুষের মধ্যে বন্য প্রাণীর গুরুত্ব জাগিয়ে তুলতে হবে। যেসব অপরাধীরা শাস্তির আওতায় এসেছে এই বিষয়টি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশসহ সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের মানুষের মাঝে ফলাও করে প্রচারের ব্যবস্থা করলে সুন্দরবনের বন্য প্রাণী নিধন কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

বাগেরহাট জেলা পুলিশের কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল আরিফ বলেন, জেলা পুলিশ বাগেরহাট সুন্দরবনের বন্য প্রাণী রক্ষায় অভিযান চালু করেছে। আমরা অপরাধ দমনের পাশাপাশি সুন্দরবন এলাকায় জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমও চালু রেখেছি।

বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী- চিতা বাঘ, লাম চিতা, উল্লুক, হরিণ, কুমির, ঘড়িয়াল, তিমি বা ডলফিন হত্যা করলে দায়ী ব্যক্তির তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা ৩ লক্ষ টাকা জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে দায়ী ব্যক্তির পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে বাঘ ও হাতি হত্যায় দণ্ডিত হলে সর্বনিম্ন দুই ও সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ডের সাথে সর্বনিম্ন এক লক্ষ এবং সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। তবে এই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে সর্বোচ্চ ১২ বছরের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১৫ লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ বাগেরহাটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নুরুল করীম বলেন, সুন্দরবনে হরিণ শিকার প্রতিরোধে বনরক্ষীদের টহল কার্যক্রম নিয়মিত চলছে। লোকবল সংকটের কারণে কার্যক্রম কিছুটা বাধাগ্রস্থ হয়। তবে বনরক্ষীদের হাতে মাঝে মধ্যে হরিণ শিকারী আটক ও মাংস জব্দ করা হচ্ছে বলে ডিএফও জানিয়েছেন।

বিএইচ/

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর