ধুঁকছে মৃৎশিল্প, অস্তিত্ব সংকটে কুষ্টিয়ার কুমাররা

আকরামুজজামান আরিফ, কুষ্টিয়া
প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১৯

কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। আধুনিকতার ছোঁয়া, প্লাস্টিক ও মেলামাইনের ভিড়ে ‘অচল’ হয়ে পড়েছে যেন মাটির তৈজসপত্র। মাটির বাসনের খুব একটা চাহিদা না হওয়ায় অস্তিত্ব সংকটে কুষ্টিয়ার কুমার সম্প্রদায়।
একসময় জেলার কুমারখালী উপজেলার গড়াই নদীর তীরবর্তী সাঁওতা, কল্যাণপুর ও কয়া গ্রামজুড়ে মাটির তৈরি তৈজসপত্র তৈরিতে ব্যস্ত থাকতেন শত শত নারী-পুরুষ। এখন সেই দৃশ্য অনেকটাই অতীত।
একসময় এই অঞ্চলে মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত ছিল এক হাজারেরও বেশি মানুষ। বর্তমানে কয়া গ্রামে মাত্র ১০-১২টি পরিবার কোনো রকমে টিকিয়ে রেখেছে এই পেশা। একদিকে উৎপাদন খরচের ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে ক্রেতাদের অনাগ্রহ—সব মিলিয়ে ধুঁকছে এ শিল্প।
কয়া গ্রামের প্রবীণ মৃৎশিল্পী গৌতম পাল বলেন, জন্মসূত্রেই আমি এই পেশার সঙ্গে জড়িত। বাবা-ঠাকুরদাদার হাত ধরেই শিখেছি কাজ। এখন বয়স হয়েছে, যতদিন বাঁচব এই পেশাতেই থাকব। সংসার কোনোভাবে চলে গেলেও বাড়তি কিছু করার সুযোগ নেই।
তিনি জানান, এঁটেল মাটি, রং, জ্বালানি—মৃৎশিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে।
গৌতম পালের মা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই মামা-মামির কাছে মাটির জিনিস বানাতে শিখেছি। বিয়ের পরেও এই পেশাতেই থেকেছি। আগে অনেক চাহিদা ছিল, এখন নেই। আগের মতো বাজার নেই, কষ্টে দিন চলে।’
বংশীধারী পাল ডিপ্লোমা শেষ করেও চাকরি না পেয়ে পারিবারিক এই কাজে যুক্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের কারখানায় ১৫-২০ ধরনের পণ্য তৈরি হয়। দইয়ের পাতিলের চাহিদা এখনো কিছুটা আছে। অর্ডার পেলে আমরা পণ্য সরবরাহ করি। পরিবার মিলে কাজ করি, তবে সরকার যদি স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে আমরা আরও ভালোভাবে কাজ চালাতে পারতাম।
স্থানীয় বাসিন্দা লালন বলেন, আগে মাটির পাতিলে রান্না হতো, মাটির বাসনে খাওয়া হতো। এখন সেসব আর দেখা যায় না। এই শিল্পকে বাঁচাতে হলে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।
মৃৎশিল্পীরা জানান, শুধু নিজেদের প্রচেষ্টায় এই ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা। তারা চান স্বল্প সুদে ঋণ, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, আধুনিক সরঞ্জামের ব্যবস্থা এবং মৃৎপণ্যের বাজারজাতকরণে সহায়তা।
হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির অংশ মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এখনই প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি না পড়লে অচিরেই হারিয়ে যাবে এই প্রাচীন শিল্প, হারিয়ে যাবে মাটির গন্ধে গড়া এক টুকরো ইতিহাস।
এমজে