রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিষাক্ত ছোঁয়া
কৈগরদাসকাঠির জীবনজুড়ে শুধুই অন্ধকার

শেখ আবু তালেব, বাগেরহাট
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১৭:৪৭
-6808d368e120b.jpg)
ছবি : বাংলাদেশের খবর
রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোলঘেঁষা পশুর নদীর বুকে জেগে ওঠা কৈগরদাসকাঠি চরের সহস্রাধিক মানুষ আজ উন্নয়নের আলোর বিপরীতে এক গভীর অনিশ্চয়তার মুখে।
স্বাধীনতার পর ভূমিহীন ও হতদরিদ্র মানুষের আশ্রয়স্থল এ চর আজ ঘনবসতিতে পরিণত হলেও, এখানকার বাসিন্দাদের জীবনে ন্যূনতম নাগরিক সুবিধাটুকুও মেলেনি।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান – সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়া এ জনপদের মানুষ প্রতিনিয়ত লড়ছেন প্রকৃতির বিরূপতা আর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার সাথে। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘আসমানী’ কবিতার সেই করুন চিত্র যেন আজও জীবন্ত এ চরের প্রতিটি ঘরে।
অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে সরকারি ১৪২টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। চরম দারিদ্র্যের কারণে এখানকার শিশুরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার পরিবর্তে বাধ্য হচ্ছে নদীতে মাছ ধরতে কিংবা অন্য কোনো কাজে যোগ দিতে। ফলে তাদের ভবিষ্যৎ ক্রমশই অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
নদীতে বিষ, জীবন বিপন্ন
একসময়ের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস পশুর নদীতে আজ মাছের আকাল। স্থানীয়দের অভিযোগ, রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য নদীতে মেশার পর থেকেই মাছ কমে যেতে শুরু করেছে। এখন তিন বেলা খাবার জোগাড় করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা মো. কাশেম আলী বলেন, “আগে এই নদীতে অনেক মাছ ছিল। আমাদের সবার সংসার চলত। কিন্তু যখন থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলো, তখন থেকেই মাছ কমতে শুরু করলো। এখন আর আগের মতো মাছ পাই না। ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার তুলে দেওয়াই কষ্টকর।”
স্বাস্থ্যসেবা যেন সোনার হরিণ
উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই চরে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা কমিউনিটি ক্লিনিক নেই। সামান্য অসুস্থতাতেও বাসিন্দাদের ছুটতে হয় পার্শ্ববর্তী গ্রামে। গর্ভবতী নারীদের জন্য এই দুর্ভোগ আরও ভয়াবহ। জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য নদী পার হয়ে দাকোপ অথবা ১২ কিলোমিটার দূরের রামপাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হয়।
সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা নূর নাহার বেগম জানান, স্বাস্থ্যসেবার অভাবে তাকে প্রতিনিয়ত চরম ঝুঁকি নিয়ে জীবন কাটাতে হচ্ছে। ‘এই আশ্রয়কেন্দ্রে থাকি। নদীর পাড়ের কাছে হওয়ায় বাধ্য হয়ে এখানেই থাকতে হয়। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবার জন্য পাঁচ কিলোমিটার দূরে কাপাসডাঙ্গায় যেতে হয়। সেখানকার ক্লিনিকেও ডাক্তার সবসময় থাকে না। তাই অনেক সময় নদী পার হয়ে চালনাতে যেতে হয় সামান্য সেবা পাওয়ার জন্য,’ কান্নারত কণ্ঠে বলেন তিনি।
নদী পারাপারের কষ্টের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “নদীতে কোনো ভালো ঘাট নেই। হাঁটু পর্যন্ত কাদা মেখে নৌকায় উঠতে হয়। সবসময় ভয় লাগে, কখন না জানি নৌকা ডুবে যায়। সরকার কত উন্নয়ন করছে, যদি আমাদের এখানে একটা ছোট হাসপাতাল করে দিত, তাহলে আমরা একটু শান্তিতে থাকতে পারতাম।”
এক টিউবওয়েল, হাজারো তৃষ্ণার্ত মুখ
পুরো চরের মানুষের জন্য সুপেয় পানির একমাত্র ভরসা একটিমাত্র নলকূপ। সেটিও প্রায় সময় বিকল থাকে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পানির ট্যাঙ্ক থাকলেও, বাকিদের নির্ভর করতে হয় নদী ও পুকুরের দূষিত পানির ওপর। ফলে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুসহ সব বয়সের মানুষ।
বিদ্যালয়ের বদলে হাতে জাল
কৈগরদাসকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযুক্ত ১১৩ জন শিশুর মধ্যে মাত্র ৬৪ জন ভর্তি হয়েছে। নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসে ৩০-৩৫ জন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্য ১০৭ জন শিক্ষার্থীর অধিকাংশই বিদ্যালয়ে যায় না।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেকসোনা খাতুন এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এখানকার বেশিরভাগ বাবা-মা অত্যন্ত দরিদ্র এবং শিক্ষার গুরুত্ব বোঝেন না। সংসারের অভাব মেটাতে তারা ছোটবেলাতেই ছেলেমেয়েদের মাছ ধরা, ইটভাটা বা হোটেলে কাজে পাঠিয়ে দেয়।’
নিরাপত্তাহীনতায় নারী জীবন
এই চরের নারীরা প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। বিভিন্ন সময় অন্তত ২০ জন নারী ও কিশোরী হেনস্তা ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। কন্যাশিশুরাও এর বাইরে নয়। এছাড়াও, নারীদের গহনা ও সঞ্চিত অর্থ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে এখানকার নারীরা সবসময় আতঙ্কিত থাকেন।
পরিবেশ বিপর্যয় ও নারী
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবও পড়েছে কৈগরদাসকাঠির জনজীবনে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে এখানকার নারীরা স্বাস্থ্য ও জীবিকা উভয় ক্ষেত্রেই চরম সংকটের সম্মুখীন হচ্ছেন। লবণাক্ত পানির কারণে গর্ভবতী নারীরা বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন, যা তাদের মাতৃত্বকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।
পরিবেশবিদ হাবিব করিম বলেন, ‘চরের মতো এলাকাগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সরাসরি জীবিকায়। পানির নিরাপত্তায় এবং নারীদের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। সরকারিভাবে একটি স্যাটেলাইট ক্লিনিক এবং নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।’
এ বিষয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ডক্টর আনিসুর রহমান বলেন, ‘রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে স্থানীয় পরিবেশের ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তা এখানকার মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলেছে। বিশেষ করে নারীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিচ্ছে, যা গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।’
এআরএস