রানা প্লাজা ধসের এক যুগ: হয়নি বিচার-পুনর্বাসন
বাঁচার লড়াই করছেন আহতরা
প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:০৬

সকালে কারখানায় এসেছিলেন পারুল বেগম। শুরু করেছিলেন কাজও, এর মধ্যে চলে যায় বিদ্যুৎ। জেনারেটর চালু হতেই বিকট আওয়াজে ধসে পড়ে ভবন। বের হওয়ার জন্য দৌড় দেন। কিন্তু পড়ে জ্ঞান হারান।
রাতে যখন জ্ঞান ফেরে নিজেকে আবিষ্কার করেন হাসপাতালের বিছানায়। পেটজুড়ে ব্যান্ডেজ। তার কিডনি ভেদ করে ঢুকে গিয়েছিল রড। এক যুগ আগে ভাগ্যক্রমে বাঁচলেও এখনো নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন তিনি।
স্বাভাবিক চলাচল করতে পারেন না, হারিয়েছেন কর্মক্ষমতাও। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে ভবনের পাঁচ তলায় ফ্যানটম টেক্স লিমিটেড কারখানার সুইং অপারেটর ছিলেন এই নারী। ওই ঘটনায় প্রাণ যায় ১১৭৫ জন শ্রমিকের। আহত হন দুই হাজারের বেশি পোশাক শ্রমিক।
বেঁচে যাওয়া বেশির ভাগ শ্রমিক এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। আর ওই ঘটনায় বিচার এখনো চলমান। এক যুগ পরে এসে এখনো রানা প্লাজার শ্রমিকদের চাওয়া সুষ্ঠু বিচার ও পুনর্বাসন।
অন্যদিকে, ভয়ংকর ওই দুর্ঘটনার পরও রাজধানীর নিকটবর্তী সাভারে এখনো ভবন নির্মাণে শৃঙ্খলা ফেরেনি। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, রানা প্লাজার ঘটনার পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি এখনো রয়েছে। এ জন্য কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান তাদের।
ফিরে দেখা ২৪ এপ্রিল, ২০১৩
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ছিল রানা প্লাজা। ভবনের প্রথম তলায় ছিল বিভিন্ন দোকান। দ্বিতীয় তলায় দোকান ও ব্যাংকের শাখা। তৃতীয় থেকে সপ্তম তলাতে ছিল পোশাক কারখানা।
এর মধ্যে তৃতীয় তলায় নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেড, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেডে এবং ফ্যানটম ট্যাক লিমিটেড, ষষ্ঠ ও সপ্তম তলায় ইথারটেক্স লিমিটেড গার্মেন্টস। অষ্টম ও নবম তলা ছিল ফাঁকা।
সেদিন সকালে ভবনে কাজ করছিলেন প্রায় ৩,০০০ শ্রমিক। আটটার দিকেই কর্মব্যস্ততা শুরু হয়েছিল। বেলা সাড়ে ৯টার দিকে বিকট শব্দে প্রথম তলার ওপরে পুরো ভবন ধসে পড়ে।
এর পরপরই শুরু হয় উদ্ধারকাজ। শুরুতে এগিয়ে আসেন স্থানীয়রা। দ্রুত সময়ে উদ্ধারকাজে যোগ দেয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, আনসার, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা।
এমন ইতিহাসের জন্ম নাও হতে পারত
২৪ এপ্রিল ধসের একদিন আগেই ওই ভবনের চার ও পাঁচ তলার কয়েকটি পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছিল। এ কারণে শ্রমিকরা সড়কে নেমে আসেন। খবর পেয়ে স্থানীয় সংবাদকর্মীরা সেখানে যান। তবে মালিক কর্তৃপক্ষ সংবাদকর্মীদের ভবনে প্রবেশ করতে দেয়নি। তারা যোগাযোগ করেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। বিষয়টি নিয়ে খবর প্রকাশ হয় সংবাদমাধ্যমে।
বিকেলের দিকে ওই সময়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন সরদার ভবনের ফাটল পরিদর্শন করেন। এরপর ব্যবসায়ী ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের বলেন, ‘এ ফাটলে তেমন কোনো সমস্যা নেই, বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা নেই। সামান্য প্লাস্টার উঠে গেছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এরপর ইউএনও চলে যান।
এর কয়েক ঘণ্টা পরেই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভবন ধসের সাক্ষী হয় বাংলাদেশসহ সাড়া বিশ্ব। প্রাণ হারায় হাজারো শ্রমিক। ওই ঘটনার পরই ওই ইউএনওকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আহত শ্রমিক, শ্রমিক নেতা ও সুশীল সমাজের দাবি, প্রশাসন যথাযথ তৎপরতা রাখলে হয়তো এমন ঘটনা এড়ানো যেত।
অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন, মৃত লাশের সাক্ষী অধরচন্দ্র স্কুল মাঠ
ধসে পড়া রানা প্লাজা থেকে একে একে উদ্ধার হতে থাকে জীবিত, আহত, মৃত মানুষের দেহ। আহতদের নেওয়া হয় আশপাশের হাসপাতালে। আর মৃতদের দেহ নেওয়া হয় সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে।
টানা ১৭ দিন ধরে চলা উদ্ধার অভিযানে উদ্ধার হওয়া প্রতিটি মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে করে নেওয়া হতো ওই মাঠে। লাশের অপেক্ষায় থাকা স্বজনরা ছুটে আসতেন সাইরেন শুনলেই। এই বুঝি স্বজনের মরদেহ এলো! স্বজনদের আহাজারিতে দিনরাত ভারী হয়ে থাকত অধরচন্দ্র স্কুল মাঠ।
প্রায় দেড় কিলোমিটার সড়কের পুরোটা জুড়েই তখন কান্না আর সাইরেনের আওয়াজ। অধরচন্দ্রের ওই মাঠ এখনো বয়ে বেড়ায় সেই স্মৃতি।
ওই সময় স্কুলটিতে পড়তেন আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, ‘আগে ক্লাসের বাইরেও প্রচুর ঘোরাফেরা, খেলাধুলা করতাম এই মাঠে। কিন্তু রানা প্লাজার ধসে পড়ার পর মৃত লাশগুলো সারি সারি করে রাখা হয়েছিল এখানে। এখনো গা ছমছম করে ওঠে।’
হতাহত যত
প্রায় ১৭ দিনের উদ্ধার অভিযানে রানা প্লাজার ভবন থেকে ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল ২,৪৩৮ জন শ্রমিককে।
আহতদের অনেকেই এখনো দুর্বিষহ সেই দিনের স্মৃতি বয়ে বেরাচ্ছেন। অনেকেই অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গু। এখনো সেদিনের স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় তাদের।
হতাহত শ্রমিকের স্মৃতিতে নির্মিত শহীদ বেদি এখন ‘প্রতিবাদের প্রতীক’
‘হতভাগ্য’ শ্রমিকদের স্মরণে ২০১৩ সালের ২৪ মে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের সামনে একটি শহীদ বেদি নির্মাণ করেন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা।
অস্থায়ী শহীদ বেদিটির নামকরণ করা হয় ‘প্রতিবাদ-প্রতিরোধ’। এ শহীদ বেদিটিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন চালিয়ে আসছে নানা আন্দোলনের কর্মসূচি। এটি এখন হয়ে উঠেছে ‘প্রতিবাদের প্রতীক।
এখন যেমন আছে রানা প্লাজার সেই স্থান
ধসের পরপরই প্রায় সব ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। এরপর জমিটির চারপাশ কাটাতার ও টিনের বেড়া দিয়ে রাখা হয়েছিল। ওই সময় প্রায় প্রতিদিনই রানা প্লাজায় আহত, নিহত আর নিখোঁজ স্বজনরা জায়গাটিতে আসতেন। তবে ধীরে ধীরে জায়গাটি পরিণত হয় পরিত্যক্ত ভূমিতে।
বর্তমানে জায়গাটিতে নানা লতাপাতার দখল। সামনে বেদি। ফুটপাতজুড়ে রাখা থাকে রেন্ট-এ কারের গাড়ি। তবে ২৪ এপ্রিল এলে নানা কর্মসূচিতে কিছুটা প্রাণ পায় জায়গাটি।
এক যুগেও মেলেনি বিচার
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় মোট তিনটি মামলা হয়। এর মধ্যে শ্রমিকদের মৃত্যুতে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে মামলা করে পুলিশ। ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে অপর মামলাটি করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আর ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে আরেকটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
তিনটি মামলার কোনোটিই এখনো শেষ হয়নি। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আইনে দায়ের করা মামলাটি দীর্ঘদিন হাইকোর্টে স্থগিত হয়ে আছে। এটি বর্তমানে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন।
‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগে পুলিশের করা মামলাটি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। আর ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
ফলে হাজারো শ্রমিকের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার ওই ঘটনায় এখনো কোনো বিচার পাননি শ্রমিক ও তাদের পরিবার।
বাঁচার লড়াই করছেন আহতরা, পুনর্বাসনের দাবি
প্রায় ১২ বছর ধরে পঙ্গুত্ব নিয়ে এখনো বাঁচার লড়াই করছেন অনেকেই। অসুস্থতা আর দরিদ্রতা নিয়ে দীর্ঘদিন বসবাস করে আসলেও কেউ তাদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসেনি বলে অভিযোগ শ্রমিকদের। শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ দোষীদের শাস্তি ও শ্রমিকদের পুনর্বাসনের দাবি করে আসছেন এতদিন।
রানা প্লাজার আহত শ্রমিক পারুল বেগম বলেন, ‘আমি পেটে আঘাত পাই। এত বছর ধরে কাজ করতে পারি না। অনেক কষ্টে পরিবার নিয়ে আছি। রানা প্লাজা ধসের এতদিন হয়ে গেছে আমাদের কেউ খবর নেয়নি। আমরা কারো কাছে ভিক্ষা চাই না। আমাদের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হোক।’
তিনি বলেন, ‘আমি চাই আমাদের যারা ক্ষতি করেছে, এই ভবনমালিক রানা, গার্মেন্টস মালিকসহ জড়িত সবার ফাঁসি চাই। সরকার আমাদের সুষ্ঠু বিচার করেনি, যদি বিচার করত তাহলে এক যুগ শেষ হতো না। আর সরকারের কাছে আমাদের অনেক দিন ধরেই দাবি, রানা প্লাজা যেখানে ছিল সেখানে একটা মার্কেট করুক এবং রানা প্লাজার ভাই-বোনদের একটা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিক।’
রানা প্লাজার একটি কারখানার সুইং অপারেটর নীলুফা বেগম ধসে পড়ার ঘটনায় মারাত্মক আহত হন। এক যুগ ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন পায়ের ক্ষত। সুচিকিৎসার অভাবে ধীরে ধীরে যাচ্ছেন মৃত্যুর মুখে।
নীলুফা বেগম বলেন, ‘রানাপ্লাজা ধসে পড়ার ১২ বছর হয়ে যায়, তারপরও আমাদের খোঁজ কেউ নেয় না। আমার একটা পা মারাত্মকভাবে আহত। এগারোটা অপারেশন করা লাগছে পায়ে। পা কেটে ফেলার জন্য অনেক জায়গায় গেছি। শেষ একটা অপারেশন আছে যার জন্য অনেক টাকা লাগবে। অপারেশনের আগে টাকা জমা দেওয়া লাগবে। কিন্তু ওই টাকা আমি কই পাব?
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি, ‘মিডিয়ার ভাইগো ধন্যবাদ দেই। তারাই মনে রাখে। কেউ কোনো খোঁজখবর নেয়নি কোনোদিন। ক্ষতিপূরণ পাই নাই. বিচার পাই নাই। এইখানে হাজারো লাশ ছিল, এখানে এখন সবাই পেশাব পায়খানা করে। আমরা এখন প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করি, জায়গাটাতে একটা বিল্ডিং কইরা যারা ক্ষতিগ্রস্ত পঙ্গু আহত ভিক্ষা করে, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিক।’
যা বলছেন শ্রমিক নেতারা
রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর প্রায় প্রতিটি শ্রমিক সংগঠনই নড়েচড়ে বসে। শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ নিরাপদ রাখতে আন্দোলন শুরু করে। নিহত ও আহতদের লস অব আর্নিং-এর ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিও করেন তারা। ২৪ এপ্রিলকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করার জোর দাবি তোলেন তারা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটারস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১২ বছরে এসেও আমাদের দাবি যেগুলো ছিল তার কিছুই পূরণ হয়নি। চিকিৎসা আর পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক পরিবারগুলো মানবেতর দিন পার করছে। সরকার ও বিজিএমইএ’র প্রতি দাবি দ্রুত বিচার নিশ্চিত ও শ্রমিকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘রানা প্লাজার সব দায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতে আমরা এক যুগ ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের দাবি, রানা প্লাজার জমি অধিগ্রহণ করে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও পরিবারকে পুনর্বাসন, সুচিকিৎসা নিশ্চিত, ২৪ এপ্রিলকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা ও রানা প্লাজার সামনে একটা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করুন।’
এমজে