টেলিগ্রামের লিংকে ঢোকার মাশুল, জাবি ছাত্রী খোয়ালেন প্রায় ২ লাখ টাকা

সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৫, ১৮:২৪

কাজের ব্যস্ততায় মুঠোফোন ব্যবহার করেননি কয়েক ঘণ্টা। এরমধ্যে ফোনে মেসেজ আসে, সেগুলোও চেক করা হয়নি। তিন ঘণ্টা পর ফোন চেক করে দেখেন এসেছে দশটি ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড। আর টাকা লেনদেনের মেসেজ।
মেসেজ পড়ে দেখেন, অগ্রণী ব্যাংকে তার থাকা অ্যাকাউন্ট থেকে পূবালী ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। নিজের অজান্তেই টাকা খুইয়ে হতবাক ভুক্তভোগী এক তরুণী।
আইটি বিশেষজ্ঞের ধারণা, কোনো অননুমোদিত অ্যাপে ঢোকার কারণে হয়তো এমনটি ঘটতে পারে। ভুক্তভোগীরও সন্দেহ একই। তার ভাষ্য, ঘটনার আগের দিন টেলিগ্রামে পাওয়া লিংকে ঢোকার পর থেকেই মুঠোফোনে অস্বাভাবিকতা টের পাচ্ছিলেন।
এ ঘটনায় বুধবার (০৭ মে) সাভারের আশুলিয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন তিনি। ভুক্তভোগী তরুণী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম আবর্তনের শিক্ষার্থী।
ভুক্তভোগী তরুণী বলেন, ‘২০২৩ সালের ২৯ মে অগ্রণী ব্যাংকের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় অ্যাকাউন্টটি চালু করি। এরপর থেকে নিয়মিত এ অ্যাকাউন্টে লেনদেন করি। গত দুই বছর ধরেই অগ্রণী ব্যাংকের স্মার্ট ব্যাংকিং অ্যাপ নিয়মিত ব্যবহার করি। সবশেষ গত ৬ মে দুপুরের দিকে ব্যাংকের অ্যাপ ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে বিকাশে ১৫ হাজার টাকা পাঠাই।’
‘এরপর বিকেল ২টা ৪৫ মিনিট থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত টানা ১০টি লেনদেন হয়। এরমধ্যে ৮টি ছিল ২০ হাজার করে, কারণ এভাবে লেনদেনের সর্বোচ্চ মাত্রাই রয়েছে ২০ হাজার টাকা। এছাড়া আরও ২৯০০ টাকা ও ১২ হাজার ৮০০ টাকার আরও দুটি লেনদেন হয়,’ যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘সবগুলো লেনদেনই হয় পূবালী ব্যাংকের খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা শাখার বাঁধন এন্টারপ্রাইজ নামে একটি হিসাব নম্বরে।’
ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘গত ৫ মে টেলিগ্রাম অ্যাপে একটা অ্যাকাউন্ট থেকে একটি মেসেজ আসে। যেখানে একটি রেস্তোরাঁর ইতিবাচক মন্তব্য করতে অনুরোধ করা হয়। সেখানে একটা ম্যাপের লিংক দেওয়া ছিল। আমি সেটিতে ঢুকি। সেখানে একটা ইমেইল চায়, আমি আমার ইমেইল দেই। তারপর ম্যাপে ঢুকে ইতিবাচক মন্তব্য দেই। এরপর রাত ১২-১টার দিকে দেখি, আমি ২-৩টি ক্রিপ্টো গ্রুপে যুক্ত হয়ে গেছি। আমি সেভাবে বিষয়টি গুরুত্ব দেইনি। গতকাল মনে হয়েছে, ফোন হ্যাং করছে। সেটিংস বদলাচ্ছে। এরমধ্যেই বিকাশের ওই লেনদেন করি। ওই দশটি লেনদেনের সময় ফোন আমার কাছেই ছিল। ওই সময় ফোনটি চেক করা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আমি আমার কাজ থেকে ফিরে ফোন চেক করে দেখি, দশটি লেনদেন হয়েছে। ওই অ্যাকাউন্টে আমার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকাগুলো পাঠানো হয়েছে। প্রতিটি লেনদেনেই ওটিপি এসেছে এবং লেনদেনগুলো সফল হয়েছে। দশটি লেনদেনই হয়েছে এনপিএসবি ট্রান্সফার। আর বেনিফিশিয়ারিতে দেখিয়েছে, আমার ফোন নম্বরটি।’
‘এরমধ্যে সন্দেহ হওয়ায় গতকালের টেলিগ্রাম মেসেজ চেক করতে গিয়ে সেই মেসেজগুলো আর খুঁজে পাইনি। ওই ইনবক্সের মেসেজও আর খুঁজে পাইনি। তবে গ্রুপগুলো রয়েছে। সেগুলো চেক করতে গিয়ে ওই গ্রুপে দেখি প্রচুর মেসেজ। টাস্ক আসছে, রিভিউ যাচ্ছে। রিভিউ অনুযায়ী টাকা দিচ্ছে। আমার ধারণা ওই রিভিউ দেওয়ার সময়ই হয়তো তারা আমার ইমেইল নিয়ে নেয় ও এক্সেস পায়,’ যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘এরমধ্যে শামসুল হক নামে একটি আইডি থেকে টেলিগ্রামে মেসেজ আসে। সেখানে আইডি লক হয়ে গেছে এমন একটি মেসেজ আসে। আমি আমার সমস্যার কথা জানাই। তখন সে আমাকে একটা লিংক দিয়ে ২ লাখ ১৪ হাজার টাকা স্থগিত রয়েছে বলে জানায়। এরপর সেটায় ঢুকে দেখি এই এমাউন্ট স্থগিত রয়েছে। সেখানে আমার অ্যাকাউন্ট দিয়ে একটা অ্যাকাউন্ট খোলা দেখতে পাই।’
‘পরে আমি অগ্রণী ব্যাংকে কল দেই। সমস্যাটি জানাই। পরে তাদের অ্যাকাউন্টটি স্থগিত করতে বলি। তারা আমাকে সব পাসওয়ার্ড বদলাতে বলে। আমি সেটি করি। এরপর এ ঘটনায় আমি আশুলিয়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করি,’ তিনি যোগ করেন।
খোয়ানো টাকা ফেরত পাওয়া ও জড়িতদের শাস্তির আওতায় এনে আর কেউ যাতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে হয়রানির শিকার না হয় সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তার।
আইটি ও আইসিটি বিশেষজ্ঞ মো. সাকের উজ্জামান বলেন, ‘যদি এ ধরনের কিছু ঘটে থাকে, তাহলে অবশ্যই ফোনটিতে কোনো অননুমোদিত অ্যাপ আছে। যেটার মাধ্যমে যিনি ওটিপি পাঠাচ্ছেন, তিনি ফোনের এক্সেস পাচ্ছেন। তিনি যখন এক্সেস পাচ্ছেন, তখন মূল ব্যবহারকারী হয়তো জানেন না, বুঝতে পারছেন না। কিন্তু তার ফোন বা টেক্সট ওই এক্সেসকারী পড়তে বা দেখতে পাচ্ছেন। হয়তো তিনি অজান্তে কোনো অ্যাপ বা কোনো কিছু ডাউনলোড করে নিয়েছেন ফোনে। এজন্য আমরা বলি, কোনো অননুমোদিত অ্যাপ, কোনো ফিশিং লিংকে ক্লিক না করার জন্য।’
তিনি বলেন, ‘ফোনের ডেটা ক্লোনিং করার এ ধরনের অনেক অ্যাপই রয়েছে, এটা হয়। যখন হয়, ভুক্তভোগী নিজেও জানেন না, তার অজান্তে এমন একটা ক্লোনিং বা ফিশিং ডাউনলোড করে নিয়েছেন।’
‘সোশ্যাল মিডিয়া বা যেকোনো সাইটে ব্রাউজ করার সময় একটু সচেতনভাবে সেগুলো যাচাই করে অননুমোদিত কিছুতে না প্রবেশ করা। আর করলেও সন্দেহ হলে ফোনের অ্যাপ ডাউনলোডের নিরাপত্তা রাখা—যাতে কোনো অ্যাপ ডাউনলোড না হয়,’ যোগ করেন তিনি।
আইটি ও আইসিটি বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘আপনি যেটা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক প্রলোভন আসে, ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায়। ঘরে বসে কাজ করুন—এমন প্রলোভন দিয়ে কাজ করানো হয়। এগুলো ছোট ছোট কাজ দেবে, টাকাও দেবে। তারপর অ্যাপ ডাউনলোড করতে বলবে বা কোনো লিংকে ঢুকতে বলবে। ম্যাপের মতো লিংক দেবে। সেটা দিয়েই মূলত ক্লোনিংয়ের ফাঁদে পা দিয়েছেন তিনি। রেস্তোরাঁর রিভিউয়ের লিংকে ঢুকে তিনি আসলে ক্লোনিংয়ের শিকার হয়েছেন।’
বিষয়টি অনুসন্ধান করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘এ বিষয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। এ ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আরিফুল ইসলাম সাব্বির/এমবি