Logo

সারাদেশ

তামাক চুল্লিতে পুড়ছে কাঠ, বিষাক্ত নিকোটিনে বিপর্যস্ত পরিবেশ

Icon

আলফাডাঙ্গা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৫, ১৮:৫২

তামাক চুল্লিতে পুড়ছে কাঠ, বিষাক্ত নিকোটিনে বিপর্যস্ত পরিবেশ

বন ও পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করেই ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় দেদারসে জ্বলছে তামাকচুল্লি। স্থানীয় সংরক্ষিত ও অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চলের বৃক্ষনিধন এবং কৃষকের বাড়ির আঙিনার বনজ-ফলজ গাছ নিধন করে এসব চুল্লিতে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ। এ ছাড়া চুল্লির বিষাক্ত ধোঁয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তামাক চুল্লিকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ধূমঘর। জমি থেকে কাঁচা তামাক পাতা সংগ্রহ করে এনে শুকানো হয় এ তামাক চুল্লিতে। বিভিন্ন তামাকজাত কোম্পানির প্রলোভনে পড়ে এ বছর আলফাডাঙ্গা উপজেলার বানা ইউনিয়নের আড়পাড়া, কোনাগ্রাম, টোনাপাড়া, গোপালপুর ইউনিয়নের কুলধর, টগরবন্দ ইউনিয়নের মালা, টিটা এলাকাসহ বেশকিছু এলাকায় ক্ষতিকর তামাকের চাষ করেছেন চাষীরা। তামাক কোম্পানিগুলো তামাক চাষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চাষিদের বীজ, সার, কীটনাশক, পাওয়ার পাম্প ও প্রয়োজনীয় অর্থসহ সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করলেও তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য তামাক চুল্লির জ্বালানি সরবরাহ করে না। ফলে তামাক চুল্লির জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে বনজ ও ফলজ সম্পদ ধংসের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হচ্ছে চাষিদের।

সরেজমিনে উপজেলার বানা ইউনিয়নের কোনাগ্রাম এলাকায় দেখা গেছে, চুল্লির অনেক দূর থেকে নাকে ভাসছে তামাক পাতা পোড়ানোর অম্লঘ্রাণ। তবে এ ঘ্রাণে কেউই আঁচ করতে পারছে না মানব শরীরের জন্য এটা কত ক্ষতিকর। আরেকটু সামনে এগুলেই চোখে পড়ে পাশাপাশি দুটি তামাক চুল্লি। যেখানে দেদারসে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ।

এ সময় তামাক চুল্লির মালিক ইদ্রিস শেখ বলেন, এ বছর ১২-১৩ বিঘা জমিতে তামাকের চাষ করেছি। এর জন্য ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি থেকে চাষাবাদের জন্য দুই লক্ষ টাকা প্রণোদনা পেয়েছি। গত দুইমাস ধরে জমি থেকে তামাক পাতা সংগ্রহ করে দুইটি চুল্লি স্থাপন করে পাতা পোড়ানো হচ্ছে। 

কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ইদ্রিস শেখ বলেন, তামাকের পাতা পোড়াতে লাকড়ি হিসেবে কাঠের পরিবর্তে কী ব্যবহার করব, সে বিষয়ে কোম্পানি থেকে কোনো দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। 

তামাক চুল্লিতে জ্বালানি কাঠ ঠেলে দেওয়ার কাজ করছেন সুফিয়া বেগম। তবে তার মুখে নেই মাস্ক বা মুখবন্ধের ব্যবস্থা। তিনি জানান, ক্ষতি জেনেও বাধ্য হয়েই কাজ করতে হয়। কারণ এখান থেকে যে আয় করি তা দিয়েই সংসার চালাতে হয়।

বানা ইউনিয়নের কোনাগ্রামের পাশেই আড়পাড়া (মাইজপাড়া) ও টোনাপাড়া এলাকায় রয়েছে আরও পাঁচটি চুল্লি। এ ছাড়া প্রায় সব ইউনিয়নের হালচিত্র এমনই। মার্চ থেকে মে পর্যন্ত চলে তামাক পাতা সংগ্রহ ও শুকানোর কাজ। উপজেলায় প্রায় অর্ধশতাধিক তামাক চুল্লিতে এখন পাতা শুকানোর কাজ চলছে। এসব চুল্লির আশেপাশেই রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, সমাজিক, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্বলছে তামাক চুল্লি, পুড়ছে কাঠ। এসব কাঠ আনা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চল এবং বাগান থেকে। এতে করে একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত এবং আশপাশের মানুষেরও চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকি দিনদিন বাড়ছে।

বানা ইউনিয়নের কামাল হোসেন নামে এক বাসিন্দা বলেন, ভোরে ঘরের জানালা খুলতেই তামাক পাতা পোড়ানোর বিষাক্ত নিকোটিনের গ্যাস আমার ঘরে প্রবেশ করে ঘরটাকে বিষাক্ত করে দেয়। অথচ তখন প্রাকৃতিক বাতাস খুবই বিশুদ্ধ থাকার কথা। আগে পেতাম বিশুদ্ধ বাতাস আর এখন পাচ্ছি তামাকের বিষাক্ত গ্যাস। তামাকের জন্য গভীর রাতেও আমরা বিশুদ্ধ বাতাস পাচ্ছি না। পুরো এলাকায় বিশুদ্ধ বাতাসের সংকট দেখা দিয়েছে। বসতবাড়ি এলাকায় তামাকচুল্লি স্থাপন বন্ধ করতে না পারলে আমরা ব্যাপকভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ব।

আলফাডাঙ্গা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মনিরুল হক সিকদার বলেন, উপজেলায় তামাকের আবাদ যে হারে বাড়ছে তাতে একদিকে যেমন ফসলি জমি কমছে, অন্যদিকে তামাক পাতা পোড়ানোর জন্য বনের কাঠ আহরণের হিড়িক পড়ছে। এতে সবুজ বনায়ন ধ্বংসের পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়ছে বন্যপ্রাণীরা।

আলফাডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তুষার সাহা বলেন, তামাক চাষাবাদ না করার জন্য কৃষি অফিস থেকে সবসময়ই কৃষকদের সচেতন করা হচ্ছে। এরপরও তামাকজাত কোম্পানির প্রলোভনে অগ্রিম টাকা বা অন্যান্য কিছু সুযোগ-সুবিধার কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকেরা তামাক চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তামাক চাষিদের কীভাবে কৃষিমুখী করা যায়; সে জন্য আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

আলফাডাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ নিয়াজ মুস্তাফি চৌধুরী বলেন, তামাক চাষের ফলে চর্ম, ক্যান্সার এবং যক্ষার মতো রোগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব রোগ দ্রুত ধরা না পড়লেও ধীরে ধীরে মানবদেহে ক্ষতি করে।

আলফাডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাসেল ইকবাল বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ-খবর নিয়ে এসব চুল্লির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাকিব/বিএইচ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর