চরে চিকিৎসা নেই, মৃত্যুই যেন ভাগ্য
কবিরাজের পানি পড়াই একমাত্র ভরসা

রাহেবুল ইসলাম টিটুল, লালমনিরহাট
প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৫, ১৮:৩২

ছবি : বাংলাদেশের খবর
লালমনিরহাটের চরাঞ্চলের মানুষ প্রতিনিয়ত চিকিৎসা সংকটে ভুগছেন। চিকিৎসা তো দূরের কথা, চরগুলোতে একজন এমবিবিএস ডাক্তারেরও দেখা মেলে না। অসুস্থ হলেই রোগীদের একমাত্র ভরসা কবিরাজ আর পানি পড়া। গুরুতর অসুস্থ হলে বাঁচার আশা প্রায় শেষ হয়ে যায়।
চর মিনার বাজার থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হয় প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ। আর কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে লাগে অন্তত ১৫–১৬ কিলোমিটার। সেখানে যেতে না আছে অ্যাম্বুলেন্স, না আছে কোনো রিকশা-ভ্যান। একমাত্র উপায়—বাঁশ দিয়ে বাঁধা চৌকিতে রোগীকে শুইয়ে ঘাড়ে করে নদীর ঘাট পর্যন্ত পৌঁছানো। তারপর নির্ধারিত সময়ের নৌকায় নদী পার হওয়া। জরুরি রোগী হলেও বিশেষ কোনো ছাড় নেই, টাকাও গুনতে হয় বেশ।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, চরে নেই কোনো যানবাহন। নদী পার হওয়ার নৌকাও চলে সময়সূচি মেনে। এক রোগীর পরিবার জানায়, তারা চৌকিতে করে রোগীকে কাঁধে তুলে নদীর ঘাটে এনেছে। এরপর নৌকায় পার হয়ে কালীগঞ্জের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে।
চরের নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের চিকিৎসা অবস্থা আরও করুণ। সন্তানসম্ভবা নারীদের প্রসব বেদনা উঠলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা মেলে না। শিশুদের ভিটামিনের অভাবে মুখে ঘা, শরীরে চুলকানি, পেটে কৃমি, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পুরুষদের শ্বাসকষ্ট, হাঁটু ব্যথা, আর নারীদের কোমর ব্যথা ও মাথা ঘোরার অভিযোগ মিলেছে প্রতিটি ঘরেই।
চরের বাসিন্দা মর্জিনা বেগম (৫০) প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। তার ছেলে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘চরে ডাক্তার নাই। কবিরাজ পানি পড়া দিছে, খাওয়াইছি, কোনো কাজ হয় নাই। এখন মা ধীরে ধীরে মরনের দিকে চলে যাচ্ছেন। তাই বাঁশের চৌকিতে করে কালীগঞ্জ হাসপাতালে নিচ্ছি। গাড়িও পাইনি, হেঁটেই যাচ্ছি।’
চরের মিনার বাজারের স্থানীয় বাসিন্দা লিটন বলেন, ‘প্রতিদিন এই কষ্ট দেখতেছি। আর ভালো লাগে না। স্থায়ীভাবে একটা হাসপাতাল দরকার।’
এছাড়া, চরে নেই স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থাও। অধিকাংশ মানুষ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করেন। বৃষ্টির পানিতে এসব মল ধুয়ে নদীতে গিয়ে পড়ে। সেই পানি দিয়েই চলে রান্নাবান্না, ধোয়া-মোছার কাজ। এতে রোগবালাই আরও বাড়ছে। প্রতিটি ঘরেই দেখা মিলেছে অপুষ্ট শিশু, কষ্টে থাকা মা ও অসুস্থ বৃদ্ধের।
চরের মানুষের অভিযোগ, ভোটে জয়ী জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচনের পরে আর খোঁজ নেন না। সংসদ সদস্য তো দূরের কথা, ইউনিয়ন চেয়ারম্যানরাও চরাঞ্চলে আসেন না। নেই কোনো পুলিশ ফাঁড়ি, নেই কোনো সেবা কেন্দ্র। বিচারের ভরসা একমাত্র গ্রাম্য সালিশ।
নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারালেও চর ছাড়তে চান না এখানকার মানুষ। বর্ষায় পানিতে ভাসেন, শুষ্ক মৌসুমে বালির সঙ্গে লড়াই করে নতুন করে গড়ে তোলেন জীবন। তবু তাদের একটাই চাওয়া—চরাঞ্চলে একটি স্থায়ী হাসপাতাল হোক। অন্তত একজন ডাক্তার থাকুক। যে সন্তানসম্ভবা মা বা শ্বাসকষ্টে ভোগা বৃদ্ধ চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে মারা যাচ্ছেন, তাদের যেন আর এই পরিণতি দেখতে না হয়।
এআরএস