মাসের পর মাস অনুপস্থিত, নিয়মিত বেতন তুলছেন নার্স!

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৫, ১৮:৫১

কিশোরগঞ্জ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাসের পর মাস অনুপস্থিত ও অনিয়মের পরেও কর্মরত এক সিনিয়র নার্স নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালকের কথিত শ্যালকের ছত্রছায়ায় এমনটি হচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগে, রাজিব চন্দ্র সূত্রধর নামের ওই সিনিয়র স্টাফ নার্স দীর্ঘদিন হাসপাতালের ডিউটিতে অনুপস্থিত থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. হেলিস রঞ্জন সরকারের (বোনের স্বামীর) দাপটে নিয়মিতভাবে বেতন ভাতা উত্তোলন করছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট নার্সের নামের পাশে বিগত কয়েক মাসের একাধিক তারিখে অনুপস্থিত লেখা রয়েছে। ওই সময়ের জন্যও তার বেতন অনুমোদিত হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠে।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, হাজিরা খাতায় রাজিবের নামের পাশে কয়েক মাসের অনুপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু সে ঠিকই বেতন তুলছে। এটা প্রশাসনিক অনিয়ম আর দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি ছাড়া কিছুই না।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে হাসপাতালটিতে পরিচালক ও সেবা তত্ত্বাবধায়ক সিন্ডিকেট করে অনিয়ম ও হয়রানিমূলক ডিউটি প্রদান করছেন।
প্রতিবেদকের কাছে থাকা ২০২৪ নভেম্বর-ডিসেম্বরের হাজিরা রেজিস্টার কপির এবং ২৫ সনের মার্চ মাসের পাতায় রাজিবের অনুপস্থিতি স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে। এছাড়া রেজিস্টারে নভেম্বর (২০২৪) মাসের পাতায় হাসপাতালের এনএসজি রোজিনা স্বাক্ষরিত একটি সংক্ষিপ্ত-পত্র সংযুক্ত রয়েছে। যাতে লেখা রয়েছে, প্রতি রাজিব চন্দ্র সূত্রধর, অনুমতি ছাড়া ১৪ তারিখ হতে ২৮ তারিখ পর্যন্ত হাজিরা খাতায় সিগনেচার করবেন না মর্মে একটি চিঠিতে সতর্কতা সংযুক্তি রয়েছে। এতে প্রমাণ হয় যে রাজিব চন্দ্র সূত্রধর উপরোক্ত দিনগুলোতে বৈধভাবে কিংবা ছুটি নিয়ে অনুপস্থিত ছিলেন না। একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে এভাবেই চলছিল তার অনুপস্থিতি ও উপস্থিতি।
এই ঘটনায় হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সেবা তত্ত্বাবধায়ক আঁখি রানী বণিকের বিরুদ্ধেও সহযোগিতার বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। সরজমিন অনুসন্ধান গিয়ে মৌখিকভাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সিনিয়র নার্সদের দাবি, এই ধরনের বেতন ছাড় একা ও প্রশাসনিক সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়।
অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে ব্যাপক অনৈতিক বলপ্রয়োগ ও ভিন্ন মতাদর্শী চাকুরিজীবীদের হয়রানির অভিযোগ রয়েছে রাজিব চন্দ্র সূত্রধরের বিরুদ্ধে।
অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে শনিবার (১০ মে) সরেজমিনে হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে গেলে সেখানে রাজিবকে পাওয়া যায়নি। হাজিরা রেজিস্টার খাতায় দেখা যায়, তিনি ৯-১০ মে সহ দুই দিন অনুপস্থিত ছিলেন বলে খাতায় উল্লেখ রয়েছে।
এই বিষয়ে অভিযুক্ত রাজিব চন্দ্র সূত্রধর বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। অফিসের কিছু ব্যক্তি এসব ফটোকপি বাহিরে দিয়ে নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে আমাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেবা তত্ত্বাবধায়ক ও এনএসজি রোজিনা এ দুই জনের বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে আমি প্রতিবাদের কারণে তারা আমার বিরুদ্ধে এসব করাচ্ছেন। আমি পাওনা ছুটির দাবি করছি। সব বিষয়ে আমি সাংবাদিকদের মাধ্যমে সঠিক তদন্ত দাবি করছি।’
এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত সেবা তত্ত্বাবধায়ক আঁখি রানী বণিক বলেন, ‘রাজিব ৯ ও ১০ মে এখনো নিয়মিত ডিউটি করছেন। তবে বাস্তবতা তার বক্তব্যের সঙ্গে মেলেনি। কারণ ওই দুইদিনও সে ডিউটিতে অনুপস্থিত ছিল। তার প্রমাণও রয়েছে ঐদিনের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের হাজিরা খাতায়। অথচ চোখ ভোজে আঁখি রানী বণিক তার উপস্থিতি দাবি করেন। পরোক্ষণেই তিনি বিষয়টি স্বীকার করেন।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত সেবা তত্ত্বাবধায়ক আঁখি রানী বণিকের কাছে আবার জানতে চাইলে প্রথমে বলেন, রাজিব ছুটি নিয়ে অনুপস্থিত ছিল, এরপর বলেন এপেন্ডিক্সের অপারেশনের পর ইনফেকশনের কারণে কিছুদিন অনুপস্থিত ছিল।
এ বিষয়ে কোনো প্রকার ছুটির আবেদন কিংবা চিকিৎসার কোন কাগজ আছে কি জানতে চাইলে তিনি তখন মত পাল্টে বলেন, ‘সত্যি কথা কি আমরা রাজিবকে দুইবার শোকজ করেছি কিন্তু তিনি কোন উত্তর দেয়নি।
তিনি আরও বলেন, ‘সব বলা যাবে না, সে পরিচালক স্যারের আত্মীয় (শ্যালক)।’
আঁখি রানী বণিকের কাছে রাজিবের ছুটি, চিকিৎসা ও শোকজের বিষয়ের সত্যতার পক্ষে কাগজ দেখতে চাইলে তিনি হতভম্ব হয়ে বলেন, এটা অফিশিয়াল বিষয়, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া দেখানো যাবে না।
এ বিষয়ে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. হেলিশ রঞ্জন সরকারের কাছে জানতে চাইলে প্রথমেই তিনি বলেন, রাজিব কোনও সময় ডিউটিতে অনুপস্থিত ছিল না। সে আজও অফিস করছে এবং ঠিকমতো অফিস করছে। কিন্তু গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে ফোন দিয়ে রাজিবকে সামনে আন্তে পারেননি পরিচালক নিজেও। এরপর তিনি আরও বলেন, রাজিবের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকলে লিখিত অভিযোগ দেন তদন্ত করে দেখব। ভারপ্রাপ্ত পরিচালক বলেন, রাজিব চন্দ্র সূত্রধর আমার কোন আত্মীয় নয়।
এ ঘটনায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং সরকারি অর্থের যথাযথ ব্যবহার হয়েছে কি না, তা যাচাইয়ে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ অনুযায়ী রাজিব চন্দ্র সূত্রধরের অনুপস্থিত দিনগুলোতে বেতন উত্তোলনের তথ্য সংক্রান্ত একটি আবেদন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিল করার প্রস্তুতি চলছে।
আব্দুর রউফ ভূইয়া/এমআই