সেন্টমার্টিনবাসীর কান্না কি সরকারের কাছে পৌঁছায় না!

কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৫, ১৭:০২
-682b0fe3222a2.jpg)
ছবি : বাংলাদেশের খবর
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে ১১ হাজার মানুষের বসবাস। এখানকার মানুষের আয়ের একমাত্র উৎস পর্যটন খাত। সেন্টমার্টিনে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পর্যটকদের ভ্রমণ বন্ধ ঘোষণা করে সরকার।
এতে আয়ের প্রধান উৎস বন্ধ হওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে দ্বীপটির ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের মধ্যে। দ্বীপের শত শত পরিবার জীবিকার অনিশ্চয়তায় দিশেহারা। কাজকর্ম নেই। হোটেল-কটেজ আর রেস্টুরেন্টগুলোর দরজা বন্ধ। ট্যুর গাইডরাও বেকার বসে আছেন।
মারমেইড রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘২০২৪ সালের ১০ মাস কোনো ব্যবসা হয়নি। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি দুই মাসের মধ্যে শুধু ৪০ দিন ব্যবসা হয়েছে। আমার হোটেলে ১৭ জন কর্মচারী ছিলেন। সবাইকে বিদায় করে একজনকে দেখাশোনার জন্য রেখেছি।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘জীববৈচিত্র্য রক্ষার নামে দ্বীপবাসীর ওপর জুলুম করা হচ্ছে। দ্বীপের মানুষ অনেক কষ্টে আছে। আর কয় দিন পর এই অবস্থাও থাকবে না। মানুষ না খেয়ে মরবে। সব দিক বিবেচনা করে সীমিত আকারেও যদি কিছু পর্যটক আসার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসবে।’
ইউরো বাংলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজুল হক বলেন, ‘২০২৪ সালে তো কোনো ব্যবসা হয়নি। দুই মাস সময় পেয়েছিলাম। এই ব্যবসায় তো আর বছর চলে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে দ্বীপবাসীর উপর দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে।’
সেন্টমার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব জেলে আবুল কালাম। তিনি বলেন, ‘আমরা ভালো নেই। গরিবের তো কর্ম করে খেতে হয়। কাজ নেই ভালো থাকব কীভাবে? স্ত্রীসহ ৫ সন্তানের সংসার। ধার করে আর কয়দিন চলতে পারব? আপনি সাংবাদিক, একটু সরকারকে বলেন না! আমরা না খেয়ে মরে যাচ্ছি। এই দ্বীপের মানুষের কান্না কি সরকারের কাছে যায় না?’
দ্বীপের আরেক বাসিন্দা জমির উদ্দিনও পেশায় একজন জেলে। আলাপকালে বলেন, ‘ঘরে মা অসুস্থ। দু’টি সন্তানের মধ্যে মেয়ের কয়েকদিন ধরে জ্বর। টাকার অভাবে ডাক্তারও দেখাতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘সাগরে মাছ ধরেই সংসার চলে। কিন্তু মাছ ধরা বন্ধ থাকায় সংসার নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েছি।’
৪নং ওয়ার্ডের মাঝেরপাড়া থাকেন মদিনা বেগম। তার সংসারে ৫ সন্তান। স্বামী ইউনিয়ন পরিষদে দফাদার হিসেবে চাকরি করতেন। কয়েকমাস আগে তার চাকরি চলে গেছে। কাজকর্ম না থাকায় অমানবিক দিন কাটছে মদিনা বেগমের পরিবারের।
একই এলাকার ফাতেমা খাতুনের বয়স ৬০। অনেক আগেই স্বামী মারা গেছেন। ফাতেমা খাতুন বলেন, ‘এই দ্বীপে এমন করুণ অবস্থা গত ৩০ বছরেও দেখিনি।’
সেন্টমার্টিনের মুদি দোকানি ইমাম শরীফ বলেন, ‘টেকনাফ থেকে মালামাল আনতে তিন জায়গায় হাসিল (চাঁদা) দিতে হয়। ৫০ কেজি ওজনের চালের বস্তায় বাড়তি ১৫০ টাকা খরচ পড়ে। অভাবের কারণে পরিচিত মানুষ বাকি চেয়ে বসেন। তখন না দিয়েও পারি না। আবার দিলেও সময়মতো টাকা পাই না।’
তিনি বলেন, ‘পর্যটক এলে মোটামুটি ভালো ব্যবসা হয়। কিন্তু গত তিন মাস ধরে মোটেও বেচাকেনা নেই।‘
সেন্টমার্টিন বাজারে ডাব বিক্রি করছিলেন এক বৃদ্ধ। তিনি জানান, দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও একটি ডাব বিক্রি করতে হয়নি।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানুষ নিজে চলতে পারছে না, সেখানে ডাব কীভাবে খাবে। পর্যটকরা থাকলে এক ধাক্কায় সব চলে যেত।’
স্থানীয়দের মতে, অভাবের কারণে দ্বীপের শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না। ইতোমধ্যে কয়েকশ শিশুর লেখাপড়া বন্ধ হয়েছে। দ্বীপে কোনো বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা নেই। সরকারি সাহায্যও আসে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে সেন্টমার্টিনে।
নিজের নাম-পরিচয় গোপন রেখে একজন বলেন, ‘টাকার অভাবে কলেজ পড়ুয়া ছেলের পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার পথে। মানসম্মানের দিকে চেয়ে যেকোনো কাজও করতে পারি না। আবার অভাবের কথা কাউকে বলতেও পারছি না। ইচ্ছে হয় বিষ খেয়ে নিজেকে শেষ করে ফেলি। এ জীবন আর ভালো লাগে না।’
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এই দ্বীপে কয়েকশ হোটেল ছিল। যেখানে দুই হাজারের বেশি মানুষ কাজ করতেন। এখন সবাই বেকার। অনেকে গৃহপালিত পশু বিক্রি করে সংসারের খরচ চালাচ্ছেন। সোনা-গয়না যা ছিল তাও বিক্রি করে দিয়েছেন অনেকে।’
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. সালাহউদ্দিন বলেন, ‘দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দাদের বিকল্প আয়ের বিষয়টি সরকারের নজরে আছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার দায়িত্ব সবার। এতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সরকারি সহায়তা প্রদান করা হবে।’
ইমতিয়াজ মাহমুদ ইমন/এমআই/ওএফ