দলিল লেখক সমিতির বিরুদ্ধে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২১ মে ২০২৫, ১৮:১৮

ছবি : বাংলাদেশের খবর
জমি ক্রেতা-বিক্রেতাদের জিম্মি করে ঠাকুরগাঁও সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের দলিল লেখক সমিতির বিরুদ্ধে বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
তাদের এ চাঁদাবাজি ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের হয়রানি বন্ধ করতে সাব-রেজিস্ট্রার অফিস থেকে কয়েকবার লিখিত পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা আমলে নিচ্ছেন না সমিতির নেতারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু সাব-রেজিস্ট্রার অফিসই নয়, বাংলাদেশ নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শহিদুল আলম ঝিনুক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, দেশের কোনো সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যেন দলিল লেখক সমিতির ব্যানারে অবৈধভাবে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা আদায় না করা হয়। এ বিষয়ে সতর্কতা ও নজরদারি রাখতে সকল সাব-রেজিস্টার ও জেলা রেজিস্টারদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের দলিল লেখক সমিতির সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে সমিতির নামে বেপরোয়াভাবে চাঁদাবাজি শুরু করেন। তার কাছে জিম্মি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় কয়েক বছর ধরে সমিতির সভাপতির চেয়ারটি দখল করে রয়েছেন তিনি।
অনেকে অভিযোগ করে বলেন, জমি রেজিস্ট্রির ক্ষেত্রে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে দলিল লেখক সমিতির বেপরোয়া চাঁদাবাজি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার পরিবর্তন হলেও দলিল লেখক সমিতির চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে সমিতির নামে একটি নির্ধারিত হারে চাঁদা আদায় করা হয়। টাকা না দিলে কাজ হয় না। সে কারণে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করান।
সমিতির সদস্য কছির উদ্দিন স্বীকার করে বলেন, প্রতিদিন ৬০/৭০টি দলিল লেখা হয়। এর বিপরীতে সমিতির নাম করে দলিলপ্রতি ৩০০ টাকা আদায় করা হয়। এ টাকা জমা হয় সংগঠনে।
আর টাকা না পেলে দলিলের ফাইল ছাড়েন না। তবে এ টাকা তিনি সমিতির ফান্ডে জমা করেন। এখানকার নিয়ম হলো ৩০০ টাকা করে দিতে হবে। টাকা না দিলে কাজ কীভাবে হবে? নিজের পকেট থেকে তো দেওয়া সম্ভব না।
জানা গেছে, ঠাকুরগাঁও সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে সনদপ্রাপ্ত দলিল লেখক রয়েছেন ৮১ জন। নিয়ম অনুযায়ী দলিল লেখকরা দলিল লেখার বিনিময়ে প্রতি পৃষ্ঠা বাবদ ও সরকারি ফি’র হার নির্ধারণ করে। সে অনুযায়ী সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের সামনে একটি তালিকা করে টানিয়ে রাখার নির্দেশনা রয়েছে।
এ ছাড়া লাইসেন্সধারী কোনো দলিল লেখক আইন লঙ্ঘন করলে সাব-রেজিস্ট্রার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন। কিন্তু সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে এসব নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না দলিল লেখক সমিতি।
দলিল করতে আসা আরিফুল ইসলাম, সমসের আলী ও আব্দুর রহিমসহ ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, দুই শতক জমি রেজিস্ট্রি বাবদ সাড়ে তিন হাজার টাকা দিতে হয়েছে। দলিল লেখক সমিতি নিয়েছে ২ হাজার টাকা। এ ছাড়াও অফিস খরচ বাবদ দেড় হাজার। তারা বলেন, শুনেছি ওই টাকা নাকি সমিতির সবাই ভাগ করে নেয়। টাকা না দিলে তো আর জমি রেজিস্ট্রি হয় না। তাই সবাই বাধ্য হয়ে টাকা দিচ্ছে। আবার কোনো কোনো ব্যক্তির কাছে নেওয়া হচ্ছে চার থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত।
সদর উপজেলা ভুক্তভোগী হুমায়ুন কবির রেজা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা যদি কোনো দলিল করতে আসি, তখন দেখি সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বা তাদের লোকজন বিভিন্নভাবে হয়রানি করেন। যখন প্রশ্ন করি—আপনাদের লিখনির ফি কত? তখন তারা বলেন, তাদের নির্ধারিত কোনো ফি নেই। তারা তাদের মতো করে মানুষের পকেট কাটছে। সমিতির নামে এরা চাঁদাবাজি শুরু করেছে।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল ওয়াদুদ সরকার আর কত বছর সভাপতি থাকবেন? তিনি মানুষকে জিম্মি করে সমিতির নামে চাঁদাবাজি করছেন। তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে টাকা ছাড়া কথা বলেন না। সমিতির এমন বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে আমরা অতিষ্ঠ। এর প্রতিকার চাই।
অভিযোগের বিষয়ে দলিল লেখক সমিতির সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরিচয় পেয়ে কথা না বলে ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে যান।
তবে নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক জানান, সমিতির নামে চাঁদাবাজি নয়, আমরা আমাদের পারিশ্রমিক নিয়ে থাকি। আর সেবা প্রত্যাশীদের কাছে যে অর্থ নেওয়া হয়, তা সমিতির ফান্ডে জমা করা হয়। ঈদে বা সমিতির কোনো সদস্য অসুস্থ হলে তাদের সাহায্য করা হয়।
একটি দলিল লেখাতে কত টাকা নেওয়া হয়—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দলিল লেখার নির্দিষ্ট কোনো ফি নেই। অনেকেই খুশি হয়ে ৫/১০ হাজার টাকাও দেন, আবার কেউ ২ হাজারও দেন।
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সদর সাব-রেজিস্ট্রার রেজাউল করিম জানান, সমিতির নামে জিম্মি করে দাতা বা গ্রহীতার কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় গ্রহণযোগ্য নয়। অফিসিয়ালভাবে বলা হয়েছে, কাউকে জিম্মি করে সমিতির নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা যাবে না। মানুষ যেন সরকারি ফিতে সেবা পায় সে বিষয়ে নজর রাখা হচ্ছে। তবে তারপরেও অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হলে ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতনদের লিখিতভাবে জানানো হবে। এছাড়াও মাঝে মাঝে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলি। অভিযোগ থাকলে সমাধান করে দেই। তারপরেও যদি আমার অগোচরে অনিয়ম বা হয়রানির অভিযোগ ওঠে, এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত ঠাকুরগাঁও জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আজমির শরিফ মারজী জানান, আমাদের জানা মতে সমিতির নামে চাঁদা বা অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া যাবে না। তবে যদি নিয়ে থাকে আর আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেন, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আবু সালেহ/এমবি