ঠাকুরগাঁওয়ে জমে উঠেছে কোরবানির গরুর হাট, দাম কেমন?

আবু সালেহ, ঠাকুরগাঁও
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫, ১৪:৪৩

ছবি : বাংলাদেশের খবর
কোরবানির ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে, ঠাকুরগাঁও জেলার হাট-বাজারগুলোতে ততই বাড়ছে কোরবানির পশু কেনাবেচার ব্যস্ততা। তবে বাজারে দেখা দিয়েছে এক ধরনের বৈপরীত্য। ক্রেতারা তুলনামূলক কম দামে গরু কিনে সন্তুষ্ট হলেও বিক্রেতা ও খামারিরা বলছেন— উৎপাদন খরচই উঠছে না, উল্টো লোকসান গুনতে হচ্ছে।
ঠাকুরগাঁও সদর, বালিয়াডাঙ্গী, রানীশংকৈল, হরিপুরসহ জেলার বিভিন্ন হাট ঘুরে দেখা গেছে, দেশি গরুর সরবরাহ ভালো। অনেক খামারি তাদের খামারে পালিত গরু বিক্রির জন্য হাটে এনেছেন। কিন্তু আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় তারা হতাশ।
একাধিক খামারি জানান, একটি গরু বড় করতে আট-দশ মাস সময় লাগে। এ সময়ে খাবার, ওষুধ ও পরিচর্যাসহ নানা খরচ হয়। কিন্তু এবার হাটে এসে তারা যে দাম পাচ্ছেন, তাতে উৎপাদন খরচই উঠছে না। তাদের দাবি, গত বছরের তুলনায় এবার গরুপ্রতি ১০ থেকে ২২ হাজার টাকা ও ছাগলপ্রতি ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা কম দাম পাওয়া যাচ্ছে।
বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা আরও অভিযোগ করেন, হাটে কাদাপানি জমে থাকা, অব্যবস্থাপনা ও অতিরিক্ত টোল আদায়ের কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
পুরাতন ঠাকুরগাঁও এলাকার গরু বিক্রেতা রানা বলেন, ‘এবার মানুষের হাতে টাকা নেই। মানুষ আলু ও মরিচ বিক্রি করে লাভ করতে পারেনি। তাই গরুর দামও নেই। গতবার যে গরু ৮০-৯০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি, এবার সেই গরু ৭০ হাজারে বিক্রি করেছি।’
অন্যদিকে, সাধারণ ক্রেতা ও অন্যান্য জেলা থেকে আসা ব্যবসায়ীরা জানান, এবারের গরুর দাম তুলনামূলক কম ও সহনীয়। ঠাকুরগাঁও রোড এলাকার আবু সালেক বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এবার গরুর দাম কিছুটা কম। মাঝারি আকারের গরুর চাহিদা বেশি।’
মো. আব্দুস সোবহান নামের একজন ক্রেতা বলেন, ‘বাজারে ‘থার্ড পার্টি’র দৌরাত্ম্য বেশি। তারপরও এবার আমি যে বাজেট নিয়ে এসেছিলাম, তাতে গরু কিনতে পেরেছি। গত বছর যে গরুর দাম ছিল ১ লাখ থেকে ৯০ হাজার, এবার সেই গরু ৭০-৭৫ হাজারে পাওয়া যাচ্ছে। আমি ৬৯,৫০০ টাকায় একটি গরু কিনেছি, যার মাংস ৯০-৯৫ কেজি হবে বলে ধারণা।’
চট্টগ্রামের হালিশহর থেকে আসা গরু ব্যবসায়ী নূর ইসলাম বলেন, ‘আমি প্রতিবছর ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন হাট থেকে গরু কিনি। এবারও এসেছি এবং তুলনামূলক কম দামে গরু পাচ্ছি।’
বড় খোঁচাবাড়ি হাটে আসা গরু ব্যবসায়ী মো. জোবাইদুল ইসলাম বলেন, ‘এই হাটে কাদাপানি জমে থাকে, হাটে চলাফেরা করা যায় না। অতিরিক্ত টোল আদায় করা হচ্ছে। একটি গাড়ি গরু আনতেই ১২-১৩ হাজার টাকা টোল দিতে হচ্ছে।’
আরেক বিক্রেতা জাকির হোসেন বলেন, ‘এবার ভারতীয় গরু নেই, তারপরও দেশি গরুর দাম কম। প্রচুর গরু এসেছে, কিন্তু ক্রেতা নেই। গ্রামের গরুগুলো এখনো বাজারে ওঠেনি, উঠলে দাম আরও কমে যাবে।’
ছাগল বিক্রেতা সাদ্দাম ও রাশেদ ইসলাম জানান, ‘ছাগলের দাম চাই ৮ হাজার, বলা হয় ৪-৫ হাজার। গতবার যে ছাগল ১০ হাজারে বিক্রি হয়েছে, এবার সেই ছাগল ৫-৬ হাজারেও যাচ্ছে না। ছাগলের মাংস কেজিপ্রতি ১ হাজার থেকে ১১০০ টাকা ছিল, এবার ৮০০ টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না।’
বেশিরভাগ ব্যবসায়ী মনে করছেন, ঈদের আগের দিনগুলোতে পশুর দাম আরও কমে যেতে পারে।
অতিরিক্ত টোল আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে বড় খোঁচাবাড়ি হাটের ইজারাদার মো. রবিউল ইসলাম টিপু বলেন, ‘সড়কে ছিনতাই ও ডাকাতির কারণে বাইরের জেলার পাইকাররা কম আসছেন। তাই গরুর দাম কিছুটা কম। অন্যবছর যেখানে প্রতি হাটে দুই থেকে আড়াই হাজার গরু বেচাকেনা হতো, এবার তা এক হাজারও হচ্ছে না।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. ইজহার আহমেদ খান বলেন, ‘ঠাকুরগাঁওয়ে কোরবানির পশুর চাহিদা ৭৫ হাজার, কিন্তু প্রস্তুত রাখা হয়েছে প্রায় ৯১ হাজার পশু। চাহিদার তুলনায় প্রায় ১৬ হাজার বেশি। জেলার প্রতিটি হাটে ভেটেরিনারি টিম মোতায়েন করা হয়েছে। গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।’
এদিকে হাটের নিরাপত্তা, জাল টাকা শনাক্ত, অতিরিক্ত টোল আদায় বন্ধ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় জেলা প্রশাসন সক্রিয় রয়েছে। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ইউএনও মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘৪০টি হাটের ইজারাদারদের নির্ধারিত ফি’র বাইরে টোল না নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। কোনো ব্যত্যয় হলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সড়কে ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। হাটগুলোর উন্নয়নে আগামী অর্থবছরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এইচকে/