সশস্ত্র মহড়া
ফরিদপুরে যুবদল নেতাদের বাড়িতে গিয়ে প্রকাশ্যে হুমকি স্বেচ্ছাসেবক ও ছাত্রলীগ নেতাদের

বাংলাদেশের প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৫, ২৩:৪৫

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যুবদলের একাধিক নেতাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা। একই সঙ্গে স্থানীয় বাজারে মব তৈরি করে যুবদলের দুই নেতাকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। এখন প্রকাশ্যে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুবদল ও ছাত্রদল নেতাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নানা হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে।
সোমবার বিকেল ও মঙ্গলবার গোপালপুর ইউনিয়নের কামারগ্রামে এই ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর বিষয়টি থানা-পুলিশকে অবহিত করা হলেও পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি অভিযুক্তরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করছে না বলে অভিযোগ স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের।
এদিকে যুবদল নেতাদের প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত ও হত্যার হুমকির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ও গোপালপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. ইনামুল হাসান, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য তারিকুল ইসলাম মেম্বার, আলফাডাঙ্গা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি কাজী কাউসার হোসেন টিটো এবং ইনামুল হাসানের ভাই মাহবুব। তারাই মূলত সোমবার বিকেলে যুবদল নেতা শাহেদ ও ঐশিককে স্থানীয় কাঞ্চন একাডেমির পাশে একটি চায়ের দোকানে মব তৈরি করে লাঞ্ছিত করে। শাহেদ কামারগ্রাম ৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি এবং ঐশিক গোপালপুর ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য। এ ঘটনার জেরে মঙ্গলবার সকালে আলফাডাঙ্গা থানায় অভিযোগ করেন তারা।
বিষয়টি জানাজানি হলে ইনামুল হাসানের নেতৃত্বে মুহূর্তের মধ্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের প্রায় শতাধিক নেতা-কর্মী জড়ো হয়। যাদের মধ্যে প্রায় বিশজন হেলমেট পরিহিত ছিলেন। একই সঙ্গে তাদের হাতে ছিল হকিস্টিক, রামদা, টেটাসহ দেশীয় বিভিন্ন অস্ত্র। সশস্ত্র দলবল প্রথমে স্থানীয় কাঞ্চন একাডেমির মাঠে জড়ো হয়। এরপর যুবদল নেতা শাহেদ ও ঐশিকের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করতে থাকে। তাদের না পেয়ে বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে স্থানীয় ছাত্রদল নেতা রিবন খানের বাড়িতেও একইভাবে হুমকি দেয় সশস্ত্র দলটি।
ভুক্তভোগী শাহেদ জানান, ঘটনার সময় স্থানীয় দোকানে কয়েকজন মিলে চা খাচ্ছিলেন। এ সময় ইনামুল হাসান বলেন, ‘এই এলাকা আওয়ামী লীগের এলাকা। এখানে বিএনপির কেউ থাকবে না।’ শাহেদ জানান, তিনি তাৎক্ষণিক ইনামুলের কথার প্রতিবাদ করেন। এতে ইনামুল আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। পরে হঠাৎ মব তৈরি করে তাকে ও তার সহকর্মী ঐশিককে হেনস্তা করে এবং সেখানেই লাঞ্ছিত করা হয়।
শাহেদ বলেন, ‘আজ (মঙ্গলবার) ইনামুল তার দলবল নিয়ে আমার বাড়িতে যায়। এ সময় তারা আমাকে গুম না হলে মেরে লাশ পুড়িয়ে ফেলবে বলে হুমকি দেয়। এরপর থেকে আমি পলাতক আছি।’
আলফাডাঙ্গা পৌর যুবদলের সভাপতি মিজানুর রহমান মিজান বলেন, ‘আমি ঘটনা জানার পর তাদের বাড়িতে ছুটে যাই। পুরো পরিবার আতঙ্কে রয়েছে। যেভাবে ইনামুল হুমকি দিয়ে এসেছে, তাতে মনে হয়েছে একটা ক্ষতি করেই ছাড়বে। আওয়ামী দোসরদের কারণে মনে হচ্ছে, আমরা এখনও রাজনীতি করতে পারছি না। কারণ থানা-পুলিশ অভিযুক্তদের ধরছে না, তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
আলফাডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শাহজালাল আলম বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।’
কে এই ইনামুল?
জানা গেছে, ছাত্রলীগের ফরিদপুর জেলার সাবেক সহসভাপতি ইনামুল হাসান ওরফে ইনামুল হক নিজ এলাকা আলফাডাঙ্গায় বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে বিস্ফোরক ও নাশকতার অভিযোগে মামলা থাকলেও পুলিশ তাকে আটক করছে না। এ নিয়ে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
জানা গেছে, ইনামুল হক ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। ওই পদে থাকা অবস্থায় তিনি গোপালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তবে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়, যা প্রায় দেড় বছর বহাল ছিল। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফুল খানের কাছে পরাজিত হন। ইনামুল হকের বাড়ি গোপালপুর ইউনিয়নের কামারগ্রামে। তার বাবার নাম কুদ্দুস মোল্লা, যিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
সূত্র জানায়, সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রহমান ও ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার অন্যতম সহযোগী এই ইনামুল হক। আব্দুর রহমানের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তিনি এলাকায় নানা অপকর্মে জড়িত ছিলেন। অন্যের জমি দখল, নারী কেলেঙ্কারি, টিআর-কাবিখার টাকা আত্মসাৎ, বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, বাড়িতে হামলাসহ তার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় বাজারগুলো থেকেও নিয়মিত মাসোহারা আদায় করতেন ইনামুল হক। আছাদুজ্জামান মিয়ার ক্যাডার হিসেবেও তার পরিচিতি রয়েছে।
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, গত ১৫ বছর ইনামুল ও তার সহযোগী স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা তারিকুল ইসলামের কারণে তারা পুরোপুরি এলাকা ছাড়া ছিলেন। আলফাডাঙ্গা শহর, গোপালপুর ইউনিয়ন ও আশপাশের এলাকার বিএনপি নেতাকর্মীরা তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন। বিএনপিপন্থীদের টার্গেট করে নানা হয়রানি চালানো হয়েছে। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও ইনামুলের আওয়ামী প্রভাব থামেনি।
শেখ হাসিনার টেলিগ্রাম মিটিংয়ে ইনামুল
সম্প্রতি ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে শেখ হাসিনা টেলিগ্রামের মাধ্যমে এক মিটিং করেন। ওই অনলাইন মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন ইনামুল হক ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য তারিকুল ইসলাম। মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেন আব্দুর রহমান। এতে ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের মাঠে সক্রিয় থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
নির্বাচন ও সহিংসতা
সর্বশেষ কথিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আলফাডাঙ্গায় ইনামুল বাহিনী নির্বাচনী বুথে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। এ সময় একাধিক নিরীহ ভোটারকে মারধর করে, নগদ অর্থ ও মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নেয়। এই ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ ইনামুলের নাম বাদ দিয়ে এজাহার দিতে বলে।
চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় নয়ছয়ের অভিযোগ
নিয়ম ভেঙে অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় একটি খেয়াঘাট ইজারা দেন গোপালপুর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান ইনামুল। পরে উপজেলা প্রশাসন ঘাটের ইজারা বাতিল করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ইনামুল একজন মাঝিকে মারধর করেন। ওই ঘটনায় মাঝি ওবায়দুর রহমান ইনামুলের বিরুদ্ধে আলফাডাঙ্গা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন (ডায়েরি নম্বর– ১১৬৮)।
এছাড়া তার বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, প্রবীণদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। যৌতুক না পেয়ে স্ত্রীকে নির্যাতন, পরে মামলা শেষে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানোর অভিযোগও রয়েছে। মহল্লাদার বা চৌকিদারের চাকরি দেওয়ার আশ্বাসে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। একাধিকবার তার বিরুদ্ধে ঝাড়ু মিছিল ও বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয়রা।
গৃহহীনদের ঘর নিয়েও লেনদেন
গৃহহীনদের জন্য সরকারের বিনামূল্যে বরাদ্দকৃত ঘর বিতরণে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে ইনামুলের বিরুদ্ধে। একইভাবে বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, শিশু কার্ড বিতরণে আর্থিক লেনদেন এবং বরাদ্দের চাল আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষে জুয়ার আসর বসানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।