Logo

সারাদেশ

মহামারি রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু, বরগুনাকে হটস্পট ঘোষণা

Icon

বরগুনা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৫, ১৬:০১

মহামারি রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু, বরগুনাকে হটস্পট ঘোষণা

ছবি : বাংলাদেশের খবর

বরগুনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৬৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ১৯৩ জন।

এ বছর এখন পর্যন্ত বরগুনায় ডেঙ্গুতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালেই ৫ জন মারা গেছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় বরগুনাকে ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত বরগুনায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৬৩১ জন। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৩৮ জন ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। বরিশাল বিভাগের মধ্যে বরগুনাতেই আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি—৬১ দশমিক ৮০ শতাংশ।

বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ৫৫টি চিকিৎসক পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ১৯ জন এবং ১৫০ নার্সের স্থলে রয়েছেন ৬৬ জন। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৫৫টি বেডে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। অন্যান্য রোগ মিলিয়ে প্রতিদিন ভর্তি থাকছেন প্রায় ৫০০ জন। পাশাপাশি আউটডোরে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরও প্রায় ৫০০ জন। ফলে তীব্র চিকিৎসক ও নার্স সঙ্কটে ভোগান্তি বাড়ছে।

গুরুতর রোগীদের অনেককে বরিশাল কিংবা ঢাকায় পাঠাতে হচ্ছে। সম্প্রতি কলেজ ব্রাঞ্চ রোড এলাকার পাপড়ি বেগম (৬৫) ঢাকায় নেওয়ার পথে মারা যান। এর আগে খামারবাড়ির স্কুলছাত্র ওমর আল আরাবি বর্তমানে ঢাকার এক বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি। একইভাবে নারী উদ্যোক্তা আজমেরী মোনালিসা জেরিনও ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ করেন।

বরগুনা সদর হাসপাতালে ভর্তি শিল্পী বেগম বলেন, আমি ও আমার দেড় বছরের ছেলে দুজনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা বা ওষুধ কিছুই দিচ্ছে না। সব বাইর থেকে কিনতে হচ্ছে। আমার স্বামী রিকশা চালায়। এ খরচ কীভাবে চালাবো?

আরেক রোগী মিজান রানা অভিযোগ করে বলেন, চারদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। কিন্তু হাসপাতালের স্টকে একটি সাধারণ স্যালাইনও নেই। এমনকি বাজারের ফার্মেসিতেও পাওয়া যাচ্ছে না। ডাক্তারও সময়মতো পাওয়া যাচ্ছে না।

ডেঙ্গু আক্রান্ত গৌরিচন্না এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আলিম জানান, আমার পরিবারে আমিসহ ৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছি। এলাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো কর্মী নেই। ড্রেনেজ ব্যবস্থাও নাজুক। ঢাকায় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরেছি।

বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স ইশরাত জাহান বলেন, এবার কোরবানির ঈদেও ছুটি পাইনি। পরিবার রেখে রোগীদের সেবায় নিয়োজিত রয়েছি। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল হলেও ১০০ শয্যার নার্স দিয়ে চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম। এতে প্রায় প্রতিদিন পাঁচ শতাধিকেরও বেশি ভর্তি রোগী সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়।

সচেতন নাগরিক কমিটির বরগুনা শাখার সভাপতি কামাল হোসেন বলেন, বৃষ্টির পর শহরের অর্ধেক রাস্তাই পানিতে তলিয়ে যায়। জলাবদ্ধতা ও অপরিকল্পিত ড্রেনেজ শহরকে মৃত্যুফাঁদে পরিণত করেছে। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. রেজওয়ানুর আলম বলেন, বরগুনায় ডেঙ্গুর পিক সিজন চলছে। ৫৫ বেডের অনুকূলে ভর্তি রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে আমাদের চিকিৎসকসহ নার্সের সংখ্যাও কম। হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে, প্রতি ঘরেই ডেঙ্গু রোগী আছে। দিন দিন এটি মহামারির আকার ধারণ করছে। বর্তমানে মহাবিপর্যের সম্মুখীন, চিকিৎসাসেবা আমাদের সক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।

বরগুনার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ্ বলেন, হঠাৎ করে বরগুনায় এত ডেঙ্গু আক্রান্ত—এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। তবে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু বা এ ধরনের রোগ নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করে। তারা হয়তো এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারবেন। তবে শহরে পর্যাপ্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা না থাকা, রোগীদের অসচেতনতা ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী না চলার কারণেও অনেকাংশে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। 

তার দাবি, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মশারি ব্যবহার করতে বললেও তারা তা গুরুত্ব দেন না। ফলে একজনের থেকে অন্যজনের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া বরগুনা ডায়রিয়া-প্রবণ এলাকা হওয়ায় প্রচুর ডাবের খোসা যত্রতত্র ফেলে রাখা হয়। যার কারণে বর্ষার মৌসুমে পানি জমে এডিস মশার প্রজনন বাড়ে।

এ বিষয়ে বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, গত দুই মাস ধরেই বরগুনায় ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এর প্রেক্ষিতে আমরা কয়েকটি সভা করেছি। মশক নিধনে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পৌরসভা কর্তৃপক্ষ অব্যাহত রেখেছেন।

তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। বিশেষ করে চিকিৎসক ও নার্স সংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। আশা করি, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

খান নাঈম/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ডেঙ্গু ভাইরাস স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর