Logo

সারাদেশ

রিফাত হত্যার ৬ বছর

মিন্নিকে ফাঁসিয়েছেন আ.লীগের প্রভাবশালীরা : মিন্নির বাবা

Icon

বরগুনা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫, ১০:০৮

মিন্নিকে ফাঁসিয়েছেন আ.লীগের প্রভাবশালীরা : মিন্নির বাবা

বরগুনার আলোচিত রিফাত হত্যা ছয় বছর পূর্তি। ছবি : সংগৃহীত

২০১৯ সালের ২৬ জুন। বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে স্ত্রীর সামনেই প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রিফাত শরীফ নামে এক যুবককে। সেই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়।

বহুল আলোচিত সেই হত্যাকাণ্ডের ছয় বছর পূর্ণ হলো আজ (২৬ জুন) বৃহস্পতিবার।

বরগুনার চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় ২৪ জনকে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১১ জনকে ১০, পাঁচ ও তিন বছরের কারাদণ্ড এবং বাকিদের খালাস দেন আদালত।

তবে মামলার অন্যতম আসামি নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে ফাঁসানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার পরিবার। 

মিন্নির পরিবারের দাবি, তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথের কুকর্ম আড়াল করতেই মিন্নিকে সাক্ষী থেকে আসামি বানানো হয়। সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব, জোরপূর্বক মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়সহ পুলিশের বিরুদ্ধেও গুরুতর অভিযোগ তোলেন তারা।

মিন্নির পরিবারের দাবি, তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাংসদ ও প্রভাবশালী নেতা ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথের কুকর্ম ধামাচাপা দিতেই সাক্ষী থেকে আসামি করা হয়েছে মিন্নিকে। এছাড়াও ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব, জোরপূর্বক মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়সহ পুলিশের বিরুদ্ধেও গুরুতর অভিযোগ তোলেন তারা।

২০১৯ সালের ২৬ জুন সকাল সোয়া ১০টায় বরগুনা সরকারি কলেজের গেটে প্রকাশ্যে স্ত্রীর সামনেই রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ ঘটনায় মামলা হলে নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী করা হয়। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যেই রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে রিফাতের স্ত্রী মিন্নিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রধান সাক্ষী থেকে আসামি হয়ে কারাগারে যান তিনি।

এরপর ২০২০ সালে চাঞ্চল্যকর এ মামলায় মিন্নিসহ ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। বর্তমানে মিন্নি কাশিমপুর মহিলা কারাগারে আছেন। তবে তার পরিবারের দাবি, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচবারের সাংসদ ও প্রভাবশালী নেতা ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথের কুকর্ম আড়াল করতে অন্যায়ভাবে ফাঁসানো হয়েছে মিন্নিকে।

মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, ‘যেখানে মিন্নি তার স্বামীকে হাজারো মানুষের সামনে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ। শেষ পর্যন্ত সে খুনি হয়েই গেল শুধু এ শম্ভুদার কারণে। সে এমন একটা পরিকল্পনা এখানে করেছে তার ছেলেকে বাঁচানোর জন্য। তার ছেলে হলো বরগুনার মাদক সম্রাট। সে মাদকের ডিলার এবং এই নয়ন বন্ড থেকে শুরু করে বরগুনার যত মাদকাসক্ত মানুষ, যুব সমাজটা সবই তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিশোর গ্যাং বন্ড বাহিনী আওয়ামী লীগের এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথের ছত্রছায়ায় ছিল। এ বন্ড বাহিনীর মাদকের ব্যবসা চালাতো সুনাম। তাকে বাঁচাতেই শম্ভু নির্দোষ মিন্নিকে ফাঁসিয়েছে।

মিন্নির বাবা বলেন, শম্ভুর ক্ষমতার কারণে তখনকার প্রশাসন অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মিন্নিকে আসামি শনাক্ত করার কথা বলে বাসা থেকে নিয়ে যায়। পরে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। রিমান্ডে মিন্নির কাছ থেকে পুলিশ জোর করে জবানবন্দি নিয়েছিল। শম্ভুর ভয়ে কেউ তখন মুখ খোলার সাহস পায়নি। এই শম্ভু ও তার ছেলে বরগুনার মাদক ও গ্যাং কালচারের পৃষ্ঠপোষকতা করতো। বর্তমানের নিরপেক্ষ সরকারের কাছে দাবি, বিষয়টি যেন পুনরায় তদন্ত করা হয়। মিন্নি যেন বেকসুর খালাস পায়।

বিগত দিনে তৎকালীন আওয়ামী সরকারের এই প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে সবাই চুপ থাকলেও স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর মুখ খুলতে শুরু করেছে মিন্নির প্রতিবেশী ও স্বজনরা। তাদেরও দাবি, শম্ভু তার গডফাদার ছেলের মাদক সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতেই প্রশাসনের সহযোগিতায় মিন্নিকে সাক্ষী থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বানিয়ে দিয়েছে। দ্রুত মামলাটি পুনরায় তদন্ত করে আসল অপরাধীদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তির পাশাপাশি মিন্নির মুক্তি চান তারা।

মিন্নির প্রতিবেশীরা বলেন, বরগুনার সবচেয়ে বড় মাদক ডিলার শম্ভুর ছেলে সুনাম। হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য যাতে প্রকাশ না পায়, সে জন্যই নয়ন বন্ডকে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করা হয়। এ ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক ছিলেন প্রভাবশালী এমপি শম্ভু।

প্রতিবেশী মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার কাছে জোর দাবি, অন্তত এই মামলাটা যেন আবার পুনঃতদন্ত করা হয়। পূর্ণ তদন্ত করা হলে অবশ্যই এই মামলার আসল রহস্য বেরিয়ে যাবে। আমি মনে করি, মেয়েটা নির্দোষ হয়ে জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে। মেয়েটা মূলত ষড়যন্ত্রের শিকার।

গত বছর ২১ এপ্রিল দ্বিতীয়বারের মতো আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির জামিন আবেদন হাইকোর্টে উপস্থাপন করা হয়। এটি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে কার্যতালিকায় উঠলে জামিন আবেদনটির ওপর শুনানি হবে। এদিকে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমেই জামিন পাবে মিন্নি—এমনটাই আশা তার আইনজীবীর।

মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম বলেন, মিন্নি যে রিফাত শরীফকে বাঁচাতে চেয়েছে, সে বিষয়গুলো কেন যেন তদন্তকারী কর্মকর্তা এড়িয়ে গেছেন। মিন্নি নিজেই রিফাতকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, কে রিফাতকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে তা সে পায়নি। ওই জায়গায় সিসি ফুটেজ আছে, সিসিটিভি আছে। সেই সিসি ফুটেজটা সে আদৌ উদ্ধার করেনি। জেরার সময় এই বিষয়গুলো তদন্ত কর্মকর্তা এড়িয়ে গেছেন। তার মানে কি? মিন্নিকে সে কৌশলে এই মামলায় আসামি করেছে। আমি আশাবাদী, মিন্নি উচ্চ আদালতে আপিল করছেন—সেখানে তিনি অবশ্যই নির্দোষ প্রমাণিত হবেন।

তবে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। রায় সত্যের পক্ষে হয়েছে বলে দাবি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর। তিনি বলছেন, যথাযথ সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এ মামলার রায় দিয়েছেন আদালত। 

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক কিসলু বলেন, ২০১৯ সালের আলোচিত একটি হত্যাকাণ্ড রিফাত হত্যাকাণ্ড। এখানে সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিজ্ঞ আদালত রায় দিয়েছেন। এখানে রায়ের কোনো ত্রুটি আমরা দেখতে পাইনি। সঠিকভাবেই রায় দিয়েছেন। এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন আছে। কোর্ট কী করবে না করবে, কোর্ট সম্পর্কে আমরা আলোচনা করতে পারি না। নিম্ন আদালতে যেভাবে সাক্ষ্যপ্রমাণ হয়েছে, সেখানে উচ্চ আদালতে বিজ্ঞ আইনজীবীরা বিশ্লেষণ করবেন। বিচারপতিরা বিশ্লেষণ করবেন। মিন্নি যদি খালাস পান, তবে সেটাই হবে। এটা কোর্টের বিষয়।

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ২৬ জুন সকাল সোয়া ১০টার দিকে স্ত্রী মিন্নিকে আনতে বরগুনা সরকারি কলেজে যান শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফ। এরপরই তাকে কলেজ গেটে প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করে বন্ড বাহিনীর সদস্যরা। রিফাতকে উদ্ধার করে বরগুনা সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে তার অবস্থা গুরুতর হওয়ায় বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেদিন বিকেলেই মৃত্যু হয় রিফাতের।

রিফাতের মৃত্যুর পরপরই তাকে কুপিয়ে জখম করার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং মুহূর্তেই তা ভাইরাল হয়। এরপর দেশ-বিদেশ থেকে প্রকাশ্যে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি জানানো হয়। ঘটনার পরদিন (২৭ জুন) নিহত রিফাতের স্ত্রী বরগুনা সদর থানায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ১০–১২ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন রিফাতের বাবা আব্দুল হালিম দুলাল শরীফ।

নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ছয় দিন পর (২ জুলাই) মামলার প্রধান আসামি ‘বন্ড বাহিনী’র প্রধান সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। এছাড়াও মামলার তদন্ত করতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রিফাতের স্ত্রী ও মামলার প্রধান সাক্ষী মিন্নির সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায় পুলিশ। এরপর ঘটনার ২০ দিন পর মিন্নিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক—দুই ভাগে ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। এতে ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক ও ১৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্ককে আসামি করা হয়। এরপর ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির মধ্যে নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করে ছয় আসামিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। বাকি চারজনকে খালাস দেওয়া হয়।

একই বছরের ২৭ অক্টোবর অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ জনের ছয়জনকে ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন শিশু আদালত। এছাড়া চারজনকে পাঁচ বছর ও একজনকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়ে তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়। পরে নিম্ন আদালতের এ রায়ের পর উচ্চ আদালতে আপিল করেন দণ্ডপ্রাপ্তরা।

খান নাঈম/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

হত্যা / খুন আদালত নিহত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর