কুমিল্লায় ‘ধর্ষণকাণ্ড’র নেপথ্যে বিএনপির ওয়ার্ড কমিটির পদ

বাংলাদেশের প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২৫, ২২:০০

কুমিল্লার মুরাদনগরে কথিত ‘সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণ’ ঘটনায় দেশজুড়ে আলোড়ন চলছে। কিন্তু ধর্ষণের দাবি করা হলেও নেপথ্যে উঠে এলো ভিন্ন ঘটনা। ভিডিও ভাইরাল, রাজনৈতিক উত্তাপ, ধর্মীয় সংবেদনশীলতা- সব মিলিয়ে ঘটনার নেপথ্যে ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আর ফাঁসিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য চেষ্টা। বাংলাদেশের খবরের অনুসন্ধানে উঠে আসছে এসব তথ্য।
বাংলাদেশের খবরের অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু ফজর আলীর সঙ্গেই নয়, ফজর আলীর ছোট ভাই শাহ পরানের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিল ভুক্তভোগী নারীর। এ নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে ছিল অন্তর্দ্বদ্ধ। স্থানীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্বও যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। অতীতে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে রাজনীতি করলেও ৫ আগস্টের পর বিএনপির রাজনীতিতে নাম লেখান ফজর আলী। সেই সুবাদে গত ১০ মাস ধরে নিজ এলাকায় সদর্পে অপকর্ম করে বেড়ান ফজর আলী।
বিএনপি সমর্থিত দলবল নিয়ে প্রায়ই এলাকায় মোরাল পুলিশিং অপারেশন চালাতেন তিনি। বর্তমানে ইউনিয়ন বিএনপির একটি ওয়ার্ড থেকে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিলেন ফজর আলী। ওয়ার্ড পর্যায়ের এই পদকে কেন্দ্র করেই সব কিছু ঘটে। তবে, রাজনীতির এসব মারপ্যাচ বুঝতে পারেননি ভুক্তভোগী ওই নারী। তিনি গোপনে বড় ভাই ফজর আলী ও ছোট ভাই শাহপরান উভয়ের সঙ্গেই সখ্যতা রক্ষা করে গেছেন।
এ ছাড়া এলাকার সবাই উভয়ের (প্রবাসীর স্ত্রী ও ফজর আলী) পরকীয়ার বিষয়টি অবগত বলে জানিয়েছেন রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া খোকন।
তিনি বলেন, ওই এলাকার সবাই উভয়ের পরকীয়ার বিষয়টি অবগত। ফাঁদ পেতে দুজনকে হাতেনাতে ধরেছে একটি গ্রুপ। হয়তো তাদেরকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্যই করেছে। তবে নারীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দিয়ে জঘন্য অপরাধ করেছে তারা।
বাংলাদেশের খবরকে স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে পাশের বাড়িতে পূজার অনুষ্ঠান শুরু হয়। ভুক্তভোগী ওই নারীর বাবা-মা পূজার অনুষ্ঠানে চলে গেলে ফজর আলীকে ডাকেন তিনি। ফজর আলী ওই বাড়ির দিকে রওনা করলে সেই সুযোগেই পরিকল্পিতভাবে ছোট ভাই শাহপরান ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সুমনসহ বেশ কয়েকজনকে নিয়ে ওই নারীর ঘরে যান। ফজর আলীকে বেধড়ক মারধর করে হাত-পা ভেঙে দেয় তারা। আর প্রমাণ রাখতে ওই নারীর বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ করা হয়।
এসব ভিডিও শাহপরানের সংরক্ষণে থাকলেও স্থানীয় ছাত্রলীগ সভাপতি সুমনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাতে পৌঁছায়। পরে আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে সংখ্যালঘু ইস্যুতে দেশে অস্থিরতা তৈরির উদ্দেশ্যে তা ভাইরাল করে দেওয়া হয়। ফজর আলীকে বিএনপি নেতা উল্লেখ করা হলেও জানা গেছে ৫ আগস্টে আগে তিনি আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।
সূত্রটি আরও জানায়, ছোট ভাই শাহপরানের উদ্দেশ্য ছিল তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে ওই নারীর পরকীয়া সম্পর্ক থেকে আলাদা করা ও ওয়ার্ড কমিটিতে পদ ভাগিয়ে নেওয়া। কিন্তু ছাত্রলীগ সভাপতি সুমন ও ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভিডিও ভাইরাল করে সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণের প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে সরকারবিরোধী অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশে।
বাংলাদেশের খবরের অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, ওই নারীর স্বামী দীর্ঘ ৫ বছর ধরে প্রবাসে রয়েছেন। এ সময়ই ফজর আলীর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক গড়ে উঠে। একই সময়ে ফজর আলীর ছোট ভাই শাহপরানের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলেন ওই নারী। তবে ২৬ জুন রাতে ঘটনার পরদিন ২৭ জুন ওই নারী মুরাদনগর থানায় ধর্ষণের মামলা করেন। যদিও তিনি ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে রাজি হননি, যা ধর্ষণের অভিযোগকে দুর্বল করে দেয়।
সর্বশেষ শনিবার (২৯ জুন) ওই নারীর বক্তব্য গণমাধ্যমে এসেছে। যেখানে তিনি মামলা তুলে নিতে চাইছেন। এই মামলা তিনি চালাতে চান না।
কুমিল্লা জেলা পুলিশ ও প্রশাসনের একাধিক সূত্র বাংলাদেশের খবরকে জানিয়েছেন, এটি পারস্পরিক সম্মতিতে গড়ে ওঠা সম্পর্ক। যা পরে রাজনৈতিক হাতিয়ারে রূপ নেয়।
নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন বাংলাদেশের খবরকে জানান, ফজর আলী এখন বিএনপি ঘনিষ্ঠ, ওই রাতের ঘটনার সময়ও স্থানীয় বিএনপির কিছু নেতাকর্মী তার সঙ্গে ছিল। অন্যদিকে ভিডিও ধারণ, মারধর এবং তা ভাইরাল করার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও এখন স্পষ্ট। সংখ্যালঘু নারীকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক ইস্যু বানিয়ে সরকারবিরোধী প্রপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টাও ছিল বলে সন্দেহ করছেন তারা।
কুমিল্লা জেলা পুলিশ জানিয়েছে, ফজর আলীকে রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভিডিও ধারণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কুমিল্লার পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খান বলেন, পুরো বিষয়টি এখন তদন্তানাধীন। ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, শেষ হলে বিস্তারিত জানাব। ফজর আলীকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসকের ছাড়পত্র পেলে তাকে আদালতে তোলা হবে।