১০ মাসে ১০ খুন
দৌলতপুরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি

আকরামুজ্জামান আরিফ, কুষ্টিয়া
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৭:৩৪
-687399db1f2e6.jpg)
ছবি : সংগৃহীত
কুষ্টিয়ার সীমান্তবর্তী দৌলতপুর উপজেলায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। গত ১০ মাসে ১০টি হত্যাকাণ্ডসহ প্রতিদিনের চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনায় জনজীবনে বিরাজ করছে গভীর আতঙ্ক।
প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া, দিনে-দুপুরে খুন, রাতভর ডাকাতি ও নীরব চাঁদাবাজির দাপটে ভেঙে পড়েছে শান্তিপূর্ণ জীবন। প্রশাসন স্বাভাবিক দাবি করলেও সাধারণ মানুষের চোখে পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ নয়।
স্থানীয়রা বলছেন, থানায় অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না তারা। মাদক ব্যবসা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজি ও ক্ষমতার প্রভাবের কারণে দৌলতপুর এখন ‘অপরাধের ছায়ারাজ্য’তে পরিণত হয়েছে।
১০ মাসে ১০ নৃশংস হত্যাকাণ্ড
গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে দৌলতপুরে সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গত ১০ মাসে অন্তত ১০ জন নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো : ৩০ সেপ্টেম্বর ফিলিপনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নঈম উদ্দিন সেন্টুকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা; ছাতাপাড়া বাজারে দুই ভাইকে কুপিয়ে হত্যা ও আহত কয়েকজন।
পদ্মার চর থেকে ১৮ বছর বয়সী রাজুকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা; দৌলতখালী দাড়পাড়ায় প্রতিবন্ধী নারী জাহানারা খাতুনকে ধর্ষণ ও হত্যা।
গোবরগড়ায় জমি বিরোধে গৃহবধূ মাহফুজা খাতুনকে কুড়াল দিয়ে হত্যা; ঠোটারপাড়া সীমান্তে মাদক বিরোধে প্রতিপক্ষের হামলায় চোরাকারবারী মোহন নিহত।
ভুরকাপাড়ায় শহিদুল ইসলামকে পিটিয়ে হত্যা; ২৯ জুন সেনপাড়ায় শিলা খাতুনকে কেরোসিন ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা এবং ২ জুলাই মথুরাপুর বাজারে ছুরিকাঘাতে যুবক আব্দুল আজিজ নিহত।
অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক বিরোধ, মাদক ব্যবসা, জমি বিরোধ ও সন্ত্রাসীদের হাতে সংঘটিত হয়েছে, আর আসামিরা জামিনে মুক্ত হয়ে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
ছিনতাই ও চাঁদাবাজি বেড়েছে
দৌলতপুরে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে গেছে। বাজার, ব্যাংক ও বাসাবাড়িতে নিরাপত্তার অভাব চোখে পড়ার মতো।
২ নভেম্বর ২০২৪ ফিড ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামের কাছ থেকে অস্ত্রের মুখে ৫ লাখ টাকা, মোবাইল ও স্বর্ণালংকার ছিনতাই হয়।
১৪ জানুয়ারি নগদ অফিসারকে কুপিয়ে ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
১ মার্চ গরু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা ছিনতাই হয়, যার অভিযোগ ‘আরিফ বাহিনী’র বিরুদ্ধে।
২ ও ১৪ এপ্রিল চরপাড়া ও সোনাইকুন্ডিতে সশস্ত্র গরু লুট এবং ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ছিনতাই হয়।
এছাড়াও সিরাজনগর বেলতলীপাড়ায় স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে ডাকাতি সংঘটিত হয়, যেখানে প্রায় ৫ লাখ টাকার মালামাল লুট হয়।
এসব ঘটনার অধিকাংশ থানায় অভিযোগ সত্ত্বেও তদন্ত ও আইন প্রয়োগে কার্যকর সাড়া মেলেনি। স্থানীয়দের অভিযোগ , থানায় গেলে বলে তদন্ত চলছে, অপরাধী ধরা হবে, কিন্তু বাস্তবে আমরা ভয়ের মধ্যে দিন পিার করছি।
এদিকে উপজেলার চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোও সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি তেকালা সেতু এলাকায় নির্মাণ শ্রমিকদের ঘরে বোমা বিস্ফোরণ।
পিয়ারপুর ও শেরপুরে ব্রিজ নির্মাণের শ্রমিকদের মারধর ও মোবাইল-টাকা লুট, পরে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে উড়োচিঠি পাঠানো হয়।
আইনশৃঙ্খলা অবনতির বিষয়ে দৌলতপুরের সাবেক সংসদ সদস্য রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লা অভিযোগ করে বলেন, ‘পুলিশ প্রশাসনের একাংশের সহযোগিতা ও নিরব সমর্থনে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুলিশের সখ্যতা না থাকলে এসব অপরাধের পরিমাণ এত বেড়ে যেত না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগে দৌলতপুরে এমন অবস্থা ছিল না। এখন সাধারণ মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। স্কুল-কলেজে মেয়েরা যেতে ভয় পায়, বাজারে ব্যবসায়ী নিরাপদ নয়। এটা কল্পনাও করা যেত না।’
দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাজমুল হুদা দাবি করেন, ‘অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সবসময় কাজ করছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক। বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে মাত্র।’
উপজেলার সচেতন নাগরিক, শিক্ষক ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, ‘যতদিন প্রশাসন দলীয় প্রভাব থেকে বের হয়ে নিরপেক্ষভাবে অপরাধ দমন করবে না, ততদিন দৌলতপুরে শান্তি ফিরে আসবে না। প্রয়োজন যৌথ বাহিনীর নিয়মিত অভিযান ও তীক্ষ্ণ নজরদারি।
এআরএস