Logo

সারাদেশ

বদলাচ্ছে শিশুশ্রমের ধরন

Icon

যশোর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৫, ০৯:০২

বদলাচ্ছে শিশুশ্রমের ধরন

স্কুলের ঘণ্টাধ্বনি নয়, এখন লোহার যন্ত্রপাতির ঠকঠক শব্দই ১৪ বছরের ফরহাদ হোসেনের সকাল শুরু করে। যশোর নিউমার্কেটের এক মোটরবাইক ওয়ার্কশপে ইঞ্জিন মেরামতের হেলপার হিসেবে কাজ করে সে। অথচ মন পড়ে থাকে স্কুলে। ছোটবেলার স্বপ্নগুলো এখন চাপা পড়েছে পরিবার চালানোর দায়ে।

যশোর সদর উপজেলার নূরপুর গ্রামের মিনারুল ইসলাম বাপ্পী (১৫) ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েও পড়াশোনায় টিকতে পারেনি। টাইলস মিস্ত্রি বাবার অসুস্থতা আর স্কুলের খরচ না জোটায় ঢুকে পড়েছে গ্যারেজের কর্মজীবনে। বাপ্পী এখন যশোর নিউমার্কেটের নওশাদ মোটরবাইক ওয়ার্কশপে কাজ করে।

শুধু বাপ্পী কিংবা ফরহাদ নয়, এভাবেই যশোরের অসংখ্য শিশু ঝরে পড়ছে বিদ্যালয় থেকে। যুক্ত হচ্ছে বিভিন্ন শ্রমে। তবে বদলাচ্ছে সেই শ্রমের ধরনও। সংশ্লিষ্টদের দাবি, শিশুশ্রম এখন প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে যেমন অপ্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ঝুঁকছে, তেমনি স্কুল ঝরেপড়া একটি অংশ ঝুঁকছে কিশোর গ্যাং ও মাদক সংশ্লিষ্টতায়।

জেলায় প্রায় দশ বছর ধরে শিশুশ্রম নিয়ে কাজ করে আসছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আব্দুর রশিদ খান ঠাকুর ফাউন্ডেশন (এআরকেটিফ)। সংস্থাটির সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, যশোর পৌরসভা, নওয়াপাড়া পৌরসভা এবং নাভারণ বাজার এলাকায় শিশুশ্রমে যুক্ত রয়েছে ৯ হাজার ৯৮০ জন শিশু।

জরিপ অনুযায়ী, যশোর পৌর এলাকায় শিশুশ্রমে যুক্ত ৪ হাজার ৯৯৩ জন, নওয়াপাড়ায় ৩ হাজার ৪৮৮ জন এবং নাভারণে ১ হাজার ৪৯৯ জন। এদের মধ্যে ৩ হাজার ৯৩৮ জনের বয়স ১৪ বছরের নিচে এবং ৬ হাজার ৪২ জনের বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। ছেলে শিশু ৫ হাজার ৭০০ জন এবং মেয়ে শিশু ৪ হাজার ২৮০ জন। এই শিশুরা মোট ৫৩টি ভিন্ন ভিন্ন শ্রমখাতে যুক্ত।

এ বিষয়ে সংস্থার প্রকল্প সমন্বয়কারী আব্দুর রহমান বলেন, এটি গোটা জেলার চিত্র নয়। যশোরের এই তিন এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও শ্রমঘন পরিবেশ বেশি বলেই সংখ্যাটি বেশি।

সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক প্রদীপ মার্সেল রোজারিও জানান, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, শিশুশ্রম উল্লেখযোগ্য হারে কমেনি; তবে প্রবণতার হার কমেছে। বাবা-মায়েরা এখন অনেকটাই সচেতন। নিয়োগদাতারাও আইন সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছেন।

নিউমার্কেটে গ্যারেজে কাজ করা আরেক শিশু আব্দুল্লাহ (১৪) জানায়, ফাইভ পাসের পর স্কুলে যেতে চাইলে প্রাইভেট পড়তে হয় বলে বাবা আর পাঠায়নি। তাই এখন মোটরসাইকেলের কাজ শিখছি।

উপশহর এলাকার এক গ্যারেজের মালিক সাইদুজ্জামান মুকুল বলেন, আগে অনেক শিশু শ্রমিক থাকত। এখন সংখ্যাটা কমেছে। কাজের পরিবেশও আগের চেয়ে ভালো। তবে স্কুল ছেড়ে যারা কাজে আসছে, তাদের একটি অংশ আবার কিশোর গ্যাং, বখাটেপনা বা মাদকেও জড়িয়ে পড়ছে।

এক বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা বলেন, আগে শিশুদের গ্যারেজ বা কারখানায় পাঠানো হতো কাজ শেখার উদ্দেশ্যে। এখন অনেকে নগদ আয়ের আশায় যাচ্ছে। কেউ কেউ ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাচ্ছে, কেউ আবার সহজ টাকার লোভে অপরাধ জগতে পা রাখছে।

যশোর জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা সাধন কুমার দাস বলেন, বন্দরনগরী ও শিল্পাঞ্চলসমৃদ্ধ যশোরে শিশুশ্রমের প্রবণতা রয়েছে। তবে আমরা নিয়মিত সভা ও মনিটরিং করছি। এখন শিশুদের জন্য কর্মপরিবেশ আগের তুলনায় অনেক উন্নত।

শিশুশ্রম প্রতিরোধে দীর্ঘদিন কাজ করে আসা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যশোরের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আরিফুল ইসলাম বলেন, সচেতনতা বাড়ার ফলে শিশুশ্রম কমছে। কর্মস্থলেও পরিবর্তন আসছে। নির্যাতনের ঘটনা কমেছে, সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে। তবে শিশুশ্রম নির্মূলে সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। দারিদ্র্য দূর করতে হবে, শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনতে হবে। একইসঙ্গে তাদের পরিবারকেও সামাজিক ও আর্থিক সুরক্ষা বলয়ের আওতায় আনতে হবে।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, জেলা পর্যায়ে শিশুশ্রমে যুক্ত শিশুদের পরিসংখ্যান বা সংখ্যাগত তথ্য তাদের নেই। তবে আব্দুর রশিদ খান ঠাকুর ফাউন্ডেশনের জরিপ সম্পর্কে তারা অবগত।

  • ডিআর/এটিআর

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মাদক কারবারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর