Logo

সারাদেশ

চাঁদপুরে অনুমতি ছাড়া ইউপি'র প্রশাসনিক কর্মকর্তার চেয়ারে ১৩ হিসাব সহকারী!

Icon

চাঁদপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৫, ১৫:২৬

চাঁদপুরে অনুমতি ছাড়া ইউপি'র প্রশাসনিক কর্মকর্তার চেয়ারে ১৩ হিসাব সহকারী!

দাপ্তরিক অনুমতি ছাড়াই কচুয়া ৭নং সদর দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তার চেয়ারে হিসাব সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর নাছির হোসেন সোহেল। ছবি : বাংলাদেশের খবর

চাঁদপুরের আট উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদ শূন্য। এসব পদে কোন ধরণের দাপ্তরিক চিঠি ছাড়াই দায়িত্ব পালন করছেন হিসাব সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ প্রাপ্তরা। মৌখিক অনুমতির মাধ্যমে হিসাব সহকারীরা এখন প্রশাসনিক কর্মকর্তার চেয়ারে। 

এছাড়া তাদের নামে রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের ব্যাংকের যৌথ হিসাব। স্থানীয় সরকার অধিদপ্তর বলছে-এভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য অবশ্যই দাপ্তরিক চিঠি দিতে হবে।

একাধিক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।

স্থানীয় সরকারি বিভাগের দায়িত্ব পালন সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদ শূন্য হলে ওই পদে দায়িত্ব পালন করবেন পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। এই বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের ইউপি-২ শাখা থেকে ৫০৭ স্মারকে সর্বশেষ ২০২০ সালের চিঠিতে বলা হয়েছে হিসাব সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগপ্রাপ্তরা কখনোই ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করতে পারবেন না। 

এদিকে ২০১৯ সালের ৬৪৫ স্মারকের চিঠিতে হিসাব সহকারীদের কর্মবন্টন সংক্রান্ত বিষয়ে বিস্তারিত বলা রয়েছে। এতে বলা হয়, প্রশাসনিক কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে হিসাব সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগপ্রাপ্তরাও কাজ করতে পারবেন। কিন্তু তাদেরকে ইউনিয়ন পরিষদের ব্যাংক একাউন্ট পরিচালনার বিষয়ে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়নি। একই সঙ্গে ২০২৪ সালের ৪ জুলাই প্রকাশিত গেজেটে ইউনিয়ন পরিষদের ব্যাংক হিসাবের সকল আয়-ব্যয় চেয়ারম্যান ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালিত হবে বলে উল্লেখ রয়েছে। জেলায় ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তার ১৩ শূন্য পদে এমন ধরণের নিয়ম অনুসরণ না করে মৌখিক অনুমতিতে হিসাব সহকারীরা দায়িত্বসহ ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করছেন।

সরেজিমন জেলার কচুয়া উপজেলার সদর দক্ষিণ ইউনিয়ন ও পাথৈর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখা গেছে হিসাব সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তার চেয়ারে বসে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তার নির্দিষ্ট কক্ষ থাকলেও তা ব্যবহার হচ্ছে না। 

কচুয়া সদর দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের হিসাব সহকারী নাছির হোসেন সোহেল বলেন, আমরা এই পদে থাকলেও প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে আমাদের পদোন্নতির জন্য উচ্চ আদালতে রীট করা হয়েছে। তিনি কেন তার নিজস্ব কক্ষ ব্যবহার না করে অস্থায়ী দায়িত্ব হিসেবে প্রশাসনিক কর্মকর্তার কক্ষ ব্যবহার করছেন এমন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তিনি রেগে যান। বলেন চেয়ার কোন সমস্যা নয়। তিনিও চেয়ারম্যানসহ তার নিজ নামে ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করছেন। ইউনিয়ন পরিষদের সকল উন্নয়ন বরাদ্দ এবং জেনারেল একাউন্টের টাকা এসব হিসাবে জমা হয়।

একই অবস্থা ২নম্বর পাথৈর ইউনিয়ন পরিষদেও। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আক্কাছ মোল্লার বাড়িতে পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। পরিষদের কোন ভবন নেই। এই পরিষদের গত দুই মাসে আগে হিসাব সহকারী হিসেবে যোগ দিয়েছেন মো. আলমগীর হোসেন। তার নামে যৌথ একাউন্ট নম্বরে নাম পরিবর্তন করে হিসাব পরিচালনা করা হচ্ছে।

চেয়ারম্যান আক্কাছ বলেন, আমি নিজে চেয়ারম্যান হিসেবে নতুন। এখানে যিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন তিনি অন্য ইউনিয়নে বদলি হয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে শূন্যপদের কথা জানানো হলে তিনি হিসাব সহকারীকে যোগদান করার জন্য বলেন। তবে তিনি (হিসাব সহকারী) কাজে অতটা অভিজ্ঞ না। 

চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসা করা হয় হিসাব সহকারী কীভাবে যৌথ ব্যাংক একাউন্ট পরিচালনা করছেন এবং তার একাউন্ট পরিচালনার বিষয়ে দাপ্তরিক কোন চিঠি আছে কিনা। জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, কোন চিঠি নেই। ইউএনও মৌখিক অনুমতি দিয়েছেন। ইউএনও বলেছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের জেলা অফিস থেকে বলা হয়েছে এভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য। দাপ্তরিক কোন অনুমতির বিষয়ে জানেন না এই চেয়ারম্যান।

পার্শ্ববর্তী হাজীগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইউসুফ প্রধানীয়া সুমন বলেন, আমার ইউনিয়নে প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদ শূন্য হলে আমি ইউএনওর মাধ্যমে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও জেলা প্রশাসক বরার চিঠি দিয়েছি। আপাতত হিসাব সহকারী দায়িত্ব পালন করছেন। উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা উত্তোলন করতে অবশ্যই হিসাব সহকারীর নামে একাউন্টে নাম পরিবর্তন করতে হবে। তবে আমাকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে কোন চিঠি দেওয়া হয়নি।

এর আগে হাজীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখা গেছে হিসাব সহকারীর নাম মুন্নি আক্তার। তিনি কয়েকমাস আগে এই পরিষদ থেকে বদলি হয়েছেন। নতুন হিসাব সহকারী ইউসুফ সরকার রুবেল কাজ করেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা চেয়ারে বসে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি নিজের চেয়ার রেখে এই চেয়ারে কেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘এমনিতেই বসেছি। অথচ ইউনিয়ন পরিষদে প্রবেশ করেই তাকে এই কক্ষে পাওয়া গেছে।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার ৮ উপজেলার ১৩ ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তার শূন্য পদে হিসাব সহকারীদের কোন ধরণের দাপ্তরিক অনুমতি ছাড়া প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনের মৌখিক অনুমতি দিয়েছেন স্থানীয় সরকারি বিভাগের উপ-সচিব মো. গোলাম জাকারিয়া। 

হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইবনে আল জায়েদ হোসেন বলেন, হিসাব সহকারীরা প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনের বিষয়ে আমি অবগত। তবে তাদেরকে দাপ্তরিক কোন অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই বিষয়ে আপনি স্থানীয় সরকারের উপপরিচালকের সঙ্গে কথা বলেন।

কচুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ হেলাল চৌধুরী বলেন, হিসাব সহকারী যখন প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন, তখন ব্যাংক একাউন্ট কে পরিচালনা করবে! তাকে দিয়ে করাতে হবে। দাপ্তরিক অনুমতি দেয়া হয়নি বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি। তিনি বলেন, এই বিষয়ে বক্তব্য প্রয়োজন হলে জেলার স্থানীয় সরকার বিভাগে কথা বলেন।

চাঁদপুর স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. গোলাম জাকারিয়া বলেন, জেলায় ১৩টি প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদ শূন্য রয়েছে। এসব পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। কিন্তু হিসাব সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদের কর্মচারীরা উচ্চ আদালতে রীট করেন তাদেরকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য। যার ফলে এই পদে নিয়োগ হয়নি। তাদের রিট উচ্চ আদালত স্থগিত করে রেখেছেন। এমন পরিস্থিতিতে শূন্য পদে হিসাব সহকারীদের দায়িত্ব পালনের জন্য বলা হয়েছে এবং হিসাব সহকারীদের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদ শূন্য থাকলে তারা দায়িত্ব পালন করবেন। 

তিনি বলেন, ব্যাংক একাউন্ট পরিচালনার বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে কোথাও উল্লেখ নেই। চাঁদপুরের আট উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তার  শূন্য পদে দায়িত্ব পালনের জন্য আমরা কোন দাপ্তরিক চিঠি দেইনি। তবে হিসাব সহকারী হিসেবে বদলির চিঠি দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের ইউনিয়ন পরিষদ-২ এর কর্মকর্তা (উপ-সচিব) মো. নুরে আলম বলেন, কোন ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসনিক কর্মকর্তা না থাকলে পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন পরিষদ প্রশাসনিক কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কিন্তু হিসাব সহকারী থাকলে তিনিই প্রশাসনিক কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে নিয়মিত কাজ সম্পাদন করবেন। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে দাপ্তরিক চিঠি ও নিয়ম অনুসরণ করে দায়িত্ব দিতে হবে। মৌখিক নয়, শূন্য পদে স্থানীয় প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়ে দায়িত্ব দিতে পারবেন, তবে দাপ্তরিক চিঠি লাগবে।

আলআমিন ভূঁইয়া/এএ


Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর