নড়াইলের তুলারামপুরে জমে উঠেছে অর্ধশত বছরের ডোঙা হাট

কৃপা বিশ্বাস, নড়াইল
প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৪৬
-6896b68be171b.jpg)
ছবি : বাংলাদেশের খবর
নড়াইল-যশোর মহাসড়কের পাশে বড় একটি রেইনট্রি গাছের নিচে বসেছে অর্ধশত বছরের পুরনো জমজমাট ডোঙা হাট। নড়াইলের বিভিন্ন গ্রামের কারিগররা ডিঙি নৌকার চেয়েও ছোট একটি লম্বাটে জলের বাহন ‘ডোঙা’ নিয়ে এসেছে। দুই-তিন জনের বহনে উপযোগী এই ডোঙাগুলো ওই এলাকার মানুষের কাছে খুবই সমাদৃত।
প্রতি সপ্তাহের সোমবার ও শুক্রবার সকাল সাতটা থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলার বড় ডোঙার হাট বসে সদর উপজেলার তুলারামপুর বাজারে।সকাল থেকে বিক্রেতারা তাদের তৈরি ডোঙা নিয়ে জমা হতে শুরু করেন।
ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে দাম নিয়ে গুঞ্জন ও দরদাম হাটকে মুখর করে তোলে। মূল সড়কের পাশে হওয়ায় ভ্যানচালকরাও সকাল থেকে হাটে উপস্থিত থাকেন, ক্রেতাদের কেনা ডোঙা বাড়ি পৌঁছে দিতে।
নড়াইল ছাড়াও সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, মাগুরা, গোপালগঞ্জ থেকে ক্রেতারা এই হাটে ডোঙা কিনতে আসেন। গাছের বয়স, মান ও আকৃতির ওপর নির্ভর করে ডোঙার দাম নির্ধারণ হয়।
শুক্রবার (৮ আগস্ট) সকাল তুলারামপুরে দেখা যায়, কারিগররা তালগাছ দিয়ে তৈরি ডোঙাগুলোকে শেষ মুহূর্তের আঁচড় দিয়ে নিখুঁত করে তুলছেন। সাজানো ডোঙাগুলোর মাথাগুলো নানা মাছের আকারে তৈরি, যেমন মাগুর মাছের মতো ‘মজগুর মাথা’, ‘শোল মাথা’, ‘কাইল্লে মাথা’ ইত্যাদি। হাটে ক্রেতার ভিড় কিছুটা কম থাকলেও বিক্রির মৌসুম এখনও শেষ হয়নি বলে তারা আশাবাদী।
একটি ডোঙা বানাতে চারজন কারিগরের প্রায় একদিন সময় লাগে। কমপক্ষে ২০-৩০ বছর বয়সী তালগাছকে মাঝামাঝি দুইভাগ করে তৈরি হয় দুটি ডোঙা। তালগাছের নরম অংশ বাদ দিয়ে শক্ত খোলস দিয়ে গড়া হয় এই ডোঙা। তৈরির পর ভিতর ও বাহির মসৃণ করার জন্য ঘষা হয়। আলকাতরা বা রং ব্যবহার করা হয় না। সাধারণ নৌকার তুলনায় দামে কম ও বহনযোগ্য হওয়ায় ডোঙা এখানকার প্রধান জলযান।
স্থানীয়রা নদী-বিল ও স্রোতহীন জলে মাছ ধরা, শাপলা তোলা, ধান-পাট কাটার কাজে ডোঙা ব্যবহার করে। শিশুদেরও ছোট বাঁশের বৈঠা নিয়ে ডোঙায় খাল-বিল ভ্রমণ করতে দেখা যায়।
চর শালিখা গ্রামের কারিগর সোহাগ শেখ বলেন, ‘বাবা চাচাদের কাছ থেকে কাজ শিখেছি। এখন বড় ভাইরা ডোঙা বানায়, আমি ও তাদের সঙ্গে কাজ করি। বৃহস্পতিবার ও সোমবার তুলারামপুর হাটে ডোঙা বিক্রি করি। প্রতিটি ডোঙার দাম তিন থেকে চার হাজার থেকে শুরু করে বড় হলে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতা আসে।’
মাগুরার শালিখা উপজেলার রিপন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘ডোঙা মূলত মাছ ধরা, শাপলা তোলা ও শামুক আহরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। আমি আজ কয়েকটি ডোঙা দেখেছি, দাম নিয়ে দরদাম করছি। ডোঙার আয়ু নির্ভর করে গাছের সারের ওপর। গায়ে যদি কালো দাগ থাকে, তা মানসম্মত বলে মনে করা হয় এবং দামও বেশি হয়।’
তুলারামপুর হাটে ডোঙা কিনতে আসা রমেশ বিশ্বাস জানান, ‘আমার বাড়ির পাশে নদী-বিলে মাছ ধরার কাজে ডোঙা লাগে। দাম একটু বেশি হলেও মানমতো হলে কিনব। এলাকার মানুষ এই হাট থেকে ডোঙা কেনে।’
বংশ পরম্পরায় চরশালিখার প্রায় একশত পরিবার তালগাছ থেকে ডোঙা তৈরি করে। নড়াইল জেলা বিসিক কার্যালয়ের উপব্যবস্থাপক মো. সোলায়মান হোসেন বলেন, ‘এটি আদি পেশা ও ঐতিহ্য। আমরা তাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছি। তুলারামপুর হাট ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ডোঙা বিক্রি হয়।’
এআরএস