---2025-08-25T184318-68ac5a714bb62.jpg)
গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর
উত্তরের সীমান্তঘেঁষা জেলা পঞ্চগড় দেশের সংসদীয় আসনের তালিকায় প্রথম। জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসন। রাতের ভোটের তিনটি নির্বাচনে যেমন ভোটাররা উৎসবমুখর পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, তেমনি বিএনপি, জামায়াতসহ বহু দল নির্বাচনের মাঠ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল।
সরকার পরিবর্তনের পর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এবার জেলার রাজনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। ফেব্রুয়ারির নির্ধারিত নির্বাচনের আগে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নানা কর্মসূচি শুরু করেছেন। উঠান বৈঠক, পথসভা, হাটবাজারে গণসংযোগ থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলকে সঙ্গে রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত তারা।
পঞ্চগড়ের দুটি আসন-পঞ্চগড়-১ (পঞ্চগড় সদর, তেঁতুলিয়া, আটোয়ারী) ও পঞ্চগড়-২ (বোদা, দেবীগঞ্জ)। পঞ্চগড়-১ আসনটি রাজনৈতিকভাবে সবসময়ই আলোচিত। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর থেকে এ আসনটি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৯১ সালে বিএনপির মির্জা গোলাম হাফিজ, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মজাহারুল হক প্রধান জয়ী হওয়ার পর থেকে পাল্টায় সমীকরণ। ২০১৪ সালে জাসদের নাজমুল হক প্রধান জয়ী হলেও ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হন।
গত নির্বাচনে এ আসনে মোট ভোটার ছিল ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৬। হালনাগাদ তালিকায় এখন ভোটার বেড়ে ১৬ হাজার ৩৪৭ জন বেশি হয়েছে। এদের মধ্যে হিন্দু ভোটার আনুমানিক ৭৫–৮০ হাজার এবং তরুণ ভোটার প্রায় ৪০–৪৫ হাজার। নারী ভোটারের হারও উল্লেখযোগ্য। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এবার নারী ও তরুণ ভোটারদের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করতে পারে চূড়ান্ত ফলাফল।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা কার্যত স্তব্ধ। দলের জেলা সভাপতি ও পঞ্চগড়-২ আসনের সাবেক এমপি (রেলমন্ত্রী) অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজনসহ একাধিক নেতা জেলহাজতে। দলের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সম্রাটেরও কোনো খোঁজ নেই। দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় এ অঞ্চলে এখন কোনো সক্রিয়তা নেই। ফলে দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন দলকে ছাড়া নির্বাচন কী রূপ নেবে—তা নিয়ে চলছে আলোচনা।
বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সবচেয়ে আলোচিত ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের ছেলে ও দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নওশাদ জমির। ২০১৮ সালে তিনি দলীয় প্রার্থী হয়েও জয় পাননি। এবারের নির্বাচনে তিনি শুরু থেকেই সরব, নিয়মিত সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগ করছেন। তার পারিবারিক রাজনৈতিক প্রভাবও এখানে একটি বড় ফ্যাক্টর।
জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে ইতিমধ্যে ঘোষণা এসেছে জেলা আমির মাওলানা ইকবাল হোসেনের নাম। জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকেই তিনি সুশৃঙ্খলভাবে এলাকায় সংগঠন গোছাচ্ছেন, সভা-সমাবেশ করছেন এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলছেন।
বাংলাদেশ জাসদ থেকে প্রার্থী হচ্ছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল হক প্রধান। ২০১৪ সালে তিনি এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্থানীয়দের মতে, তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এখনো টিকে আছে।
নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন জুলাই অভ্যুত্থানের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। আটোয়ারী উপজেলাবাসী এই তরুণ নেতা দল গঠনের পরপরই শতাধিক গাড়িবহর নিয়ে শোডাউন করে রাজনৈতিক মহলে আলোচনায় আসেন। তিনি তরুণ ভোটারদের মধ্যে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।
এ ছাড়া জাগপার মুখপাত্র রাশেদ প্রধান (প্রয়াত শফিউল আলম প্রধানের ছেলে), জাকের পার্টির আনিছুর রহমান, গণসংহতি আন্দোলনের সাজেদুর রহমান সাজু, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ও গণঅধিকার পরিষদের মাহাফুজার রহমানও প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পঞ্চগড়-১ আসনে বিএনপির ঐতিহ্যগত ভোটব্যাংক, জামায়াতের সাংগঠনিক শক্তি এবং এনসিপির নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব-এই তিন শক্তি মিলে তৈরি করেছে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা। তবে জোট হলে বা পিআর পদ্ধতি কার্যকর হলে সমীকরণ আমূল বদলে যেতে পারে।
ভোটারদের অনেকে বলছেন, তারা আর সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও রাতের ভোট দেখতে চান না। তাদের প্রত্যাশা, যে প্রার্থী ক্লিন ইমেজের এবং উন্নয়নকেন্দ্রিক রাজনীতি করবেন, তাকেই তারা সমর্থন করবেন।
জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমরা এবার অভাবনীয় ফলাফলের আশা করছি। নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রশিক্ষণ ও সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে। তবে ন্যায্য সংস্কার, বিচার ও সমান সুযোগ নিশ্চিত না হলে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।’
বিএনপির ব্যারিস্টার নওশাদ জমির বলেন, ‘বিগত সরকার দেশের গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারকে উপহাস করেছে। পঞ্চগড়-১ আসন শুধু সীমান্ত নয়, এটি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। চা, পাথর, বালু, পর্যটন-সবকিছুই জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। ক্ষমতায় এলে আমরা এ অঞ্চলের সম্ভাবনা পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করব।’
- এমআই/এআরএস